-->

প্রক্রিয়াজাত মাংসে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে

সময়ের সাথে মানুষের জীবন ব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস। এটা সত্য যে, মানুষ আজ এক উন্নত সমাজ ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে সেই সাথে মানুষের দেহে রোগব্যাধী সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের দেহে এমন কিছু রোগ আছে যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় এবং এর সাথে খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্ক রয়েছে। এমন একটি রোগ হলো ডায়াবেটিস।


মানুষের দেহে উৎপাদিত গ্লুকোজের বিপাক ঘটাতে ইনসুলিন প্রয়োজন। দেহে কোনো কারণে ইনসুলিন উৎপাদিত না হলে বা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাঁধাগ্রস্থ হলে ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস রোগ গ্লুকোজের বিপাক না হওয়ার সাথে জড়িত। এর সাথে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে দেহে বিপাক ক্রিয়া শেষে গ্লুকোজ উৎপাদিত হয় এমন খাদ্যের কারণে ডায়াবেটিস হয় বলে মনে হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় নতুন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন দুই খন্ড মাংস খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস বৃদ্ধির প্রবণতা শতকার ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ হলো উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবার বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর অণু বৃদ্ধি করে যার কারণে ডায়াবেটিস হয়। প্রখ্যাত ল্যানসেট ডায়াডেটস এন্ড এন্ডো ক্রাইনোলজি জার্নালে এই গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বিশটি দেশের প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষের উপর বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এমন তথ্য পেয়েছেন। তারা মূলত প্রক্রিয়াজাতহীন লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত মাংস ও পোল্ট্রির মাংসের সাথে ডায়াবেটিসের কোনো সম্পর্ক আছে কী না তা যাচাইয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন। বয়স, লিঙ্গ ও দেহের ভর বিবেচনায় নিয়ে  গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৫০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত মাংস ভক্ষণ করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

মানুষের দেহে কয়েক প্রকার ডায়াবেটিস হতে পারে। এর মধ্যে ডায়াবেটিস টাইপ-২ এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রাপ্তবয়স্ক সূচক ডায়াবেটিস নামে পরিচিত। কারণ সাধারণত ৩৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের দেহে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। তবে ইদানিং এর চেয়ে কম বয়স্ক লোকের দেহে টাইপ ২ ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত ওজন বা নিশ্চল জীবন ব্যবস্থা টাইপ ২ ডায়বেটিস হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে এই রোগের সাথে জীনতাত্ত্বিক সম্পর্ক রয়েছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়াতে সারা বিশ্বের চিকিৎসকরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, শরীরচর্চা, ‍ধূমপান না করা এবং দেহের রক্তচাপ ও চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রাখা।


প্রক্রিয়াজাত মাংসের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা দলের অন্যতম গবেষক যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গবেষক নিক ওয়ারহ্যাম বলেন, “ডায়াবেটিস রোগের উপর মাংসের প্রভাব আছে। মাংস খাওয়া কমাতে পারলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। যদি প্রত্যেকে কম খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারে, তাহলে ঝুঁকির প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং নিশ্চিতভাবে এটি সবার জন্য উপকার হবে”।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) তথ্য মতে, বিশ্বের ৫৩৭ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগী। আইডিএফের তথ্যানুয়ায়ী, প্রতিনিয়ত টাইপ-২ ডায়োবিটস বৃদ্ধি পাচ্ছে। পঁচিশ বছর পূর্বের তুলনায় বর্তমানে তিনগুণ বেশি মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। একইসাথে আফ্রিকার দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চরম ঝুঁকি রয়েছে। দেশভেদে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ঝুঁকি নিয়ে গবেষক ওয়াল্টার উইলেট বলেন, “উন্নত দেশের মানুষ যারা নিয়মিত মাংস খায় তাদের জন্য এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ঝুঁকির তথ্য নিম্ন আয়ের দেশের জন্য প্রয়োজ্য ণয় এমনটি নয়, কারণ সম্প্রতি তাদের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গবেষণা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিমুক্ত থাকতে আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বড় ধরণের সহায়ক হবে।

প্রক্রিয়াজাত মাংস ও লাল মাংসে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেপ ফ্যাটি এসিড থাকে। এই ফ্যাটি এসিডের কারণে দেহে বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা যায়। তবে কেন এমনটি হয় তা গবেষক দল নিশ্চিত নয়। অন্য একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা টাইপ-২ ডায়বেটিসের সাথে জড়িত এমন একটি অণু উদঘাটন করেছেন। সিরামিড নামক অণুটির একটি ধরণ ডায়াবেটিসের সাথে জড়িত। গবেষনায় দেখা গেছে, স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার সি-১৬ টাইপ সিরামিড উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপাদান যোগান দেয়। মানুষের যকৃতে এই সি-১৬ সিরামিড উৎপন্ন হয় বলে জানা যায়। তবে নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে গ্যাসট্রো ইনটেসটিনাল ট্র্যাক্ট বা অন্ত্রে সি-১৬ সিরামিড উৎপন্ন হয়। গবেষণা দলের প্রধান অস্ট্রোলিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটির সারাহ টারপিন-নোলান বলেন, “ আমরা এই উপাদান উৎপন্ন হয় এমন দ্বিতীয় অঙ্গের সন্ধান পেয়েছি ও আর এটি চর্বিযুক্ত খাবারের কারনে হয়ে থাকে”। এছাড়াও টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিরাময়ে ওষুধ প্রস্তুতে এই গবেষণা সহায়ক হবে বলে তিনি মনে করেন। এই বিষয়ে তার অভিমত,“যদি কোনো ওষুধ কোম্পানি বিপাকীয় রোগ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগ নিরাময়ে ওষুধ প্রস্তত করতে চায়, যদি তাদের ওষুধ যকৃত ও অন্ত্রে সক্রিয় তাহলে তা একটি উৎকৃষ্ট হবে”।

সম্পাদনাঃ রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞান কর্মী

সূত্রঃ ডয়চে ভ্যালে  

Blogger দ্বারা পরিচালিত.