-->

ভার্টিকেল ফার্মিং কী আগামীর খাদ্য উৎপাদনের টেকসই কৌশল?

সভ্যতার ধারায় খাদ্য মানুষের অতি প্রয়োজনীয় ‍উপাদান। মানুষের টিকে থাকার জন্য খাদ্য আবশ্যক। আর তাই মানুষ সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আজ অবধি খাদ্য উৎপাদনে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে আসছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন নতুন গবেষণা চলছে, প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে।

কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত উপযোগী পরিবেশে ফসল আবাদ করা হয়

তবে, একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরন্তর গবেষণা চলছে। পরিবেশের উপর বিরূপ ক্রিয়া হ্রাস করে অধিক মাত্রায় খাদ্য উৎপাদন করে বিজ্ঞানীদের জন্য এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। তবে বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু সংখ্যক পরিবেশ বান্ধব কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। খাদ্য উৎপাদনের এমন একটি কৌশল হলো ‘ভার্টিক্যাল ভার্মিং”। এই পদ্ধতিতে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত কাঠামোতে উল্লম্ব বরাবর ফসল আবাদ করা হয়।  আমরা সাধারণত ভূ-স্তরের আনুভূমিক বরাবর তথা বিস্তৃত মাঠে ফসল আবাদ করা দেখে অভ্যস্ত। ভার্টিক্যাল ফার্মিংয়ে স্বল্প জায়গায় এক স্তরের উপর অন্য স্তরে বিন্যস্ত কাঠামোতে ফসল আবাদ করা হয়। তবে এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে উন্নতর প্রযুক্তি, নিবিড় পরিচর্যার দরকার পড়ে। ফলে এটা সত্য যে প্রাথমিক স্তরে এই পদ্ধতি ব্যায় সাপেক্ষ এবং অবশ্যই তা পরিচালনায় দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে ফসল আবাদে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা, আলো, পানি ও আর্দ্রতা কৃত্রিমভাবে সরবরাহ করা হয়।

পৃথিবীর বহুদেশে খাদ্য উৎপাদনে ভার্টিকেল ফার্মিং জনপ্রিয় হচ্ছে। বিশ্বের অনেক খামারে ভার্টিকেল ফার্মিং পদ্ধতিতে ফসল আবাদ সফল হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তাদের মতে, পরিবেশের উপর কোনো রকম বিরূপ ক্রিয়া না করে খাদ্য উৎপাদনে ভার্টিকেল ফার্মিং হতে পারে একটি চমৎকার কৌশল। ’ফিশচার ফার্ম’ এমন একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান যেখানে ভার্টিকেল ফার্মিং পদ্ধতিতে ফসল চাষ করা হয়। যুক্তরাজ্যের নরউইচ শহরে অবস্থিত এই খামারে ভার্টিকেল ফার্মিং পদ্ধতিতে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ টন সবুজ সবজি, দানাশস্য ও সালাদ উপযোগী ফসল উৎপাদন করা হয়।

অনেকে মনে করেন, সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তায় এই প্রযুক্তি বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। কৃষি প্রযুক্তি নির্ভর প্রতিষ্ঠান এগ্রিটেক-ই এর পরিচালক বেলিন্ডা ক্লার্কের মতে,  ভার্টিকেল ফার্মিং কৃষি শিল্পের জন্য একটি গেমচেঞ্জার হতে পারে, তবে প্রাথমিক ধাপে সঠিকভাবে এই ব্যবসা মডেল দাঁড় করানো বেশ জটিল’।

ফিশচার ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা ট্রিস্টান ফিশচার বলেন, আমি মনে করি এই পদ্ধতি সমগ্র বিশ্বের খাদ্য স্থিতিবস্থার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একইসাথে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি না করে এই পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব”।

ফিশচার ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা ট্রিস্টান ফিশচার

ভার্টিকেল ফার্মিং পদ্ধতির মাধ্যমে চাষাবাদে প্রাথমিকভাবে বেশ খরচ হয়। ড. ক্লার্ক বলেন, “অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যায়বহুল, প্রাথমিক ধাপে বেশ খরচ হয়। আপনাকে অবশ্যই উচ্চমূল্যের ফসল আবাদ করতে হবে”।

তবে উৎপাদিত ব্যায় বিবেচনা করে এমন ফসল উৎপাদন করতে হবে যা থেকে বেশি লাভ পাওয়া যায়। বিশেষ করে স্থানীয় চাহিদা বেশি, আমদানি বহুল, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি বা কসমেটিক শিল্পে উপজাত হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন ফসল আবাদ করতে হবে। গতানুগতিক ফসলের বাইরে অধিক লাভের সুযোগ আছে এমন ফসল বিবেচনায় নিতে হবে।

ভার্টিক্যাল ফার্মিং পদ্ধতিতে যে ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কারণ, এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কোনো প্রকার কীটনাশক বা বালাইনাশক প্রয়োগ না করে ফসল উৎপাদন করা হয়। হয়তো মনে হতে পারো এই পদ্ধতিতে ফসলের উৎপাদন কম হয়। তবে বিষয়টি সত্য নয়। কারণ উর্ধ্বমুখী চাষাবাদ হওয়ায় বিস্তৃত মাঠের চেয়ে জমির ব্যবহার কম হয়। দেখা গেছে ফিশচার ফার্ম তাদের খামারে চার একর (১.৬১ হেক্টর) জমিতে যে ফসল উৎপাদন করে, গতানুগতিক বিস্তৃত মাঠে সেই পরিমাণ ফসল উৎপাদন করতে ১০০০ একর (৪০৪ হেক্টর) জমি প্রয়োজন।  

অন্ধকারে বীজ অঙ্কুরোদগমের পর উজ্জ্বল আলোক পরিবেশে (২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা) স্থানান্তর করা হয়

তবে এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে বিশেষ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। ভার্টিক্যাল ফার্মিং বাস্তবায়নে নিরবিচ্ছিন্নভাবে শক্তির সরবরাহ থাকা জরুরী। ড. ক্লার্কের মতে, এই প্রযুক্তিকে টেকসই করার জন্য অবশ্যই উপযুক্ত শক্তির সরবরাহ আছে যেমন সোলার শক্তি বা জৈব জ্বালানীর উৎসের নিকটবর্তী অঞ্চলে ভার্টিকেল ফার্মিং প্লান্ট স্থাপন করতে হবে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে পরিবেশ বান্ধব এই প্রযুক্তি ফলপ্রসূ হবে। একদিকে পরিবেশ সুস্থ থাকবে, অন্যদিকে স্বল্প জায়গায় বিপুল সংখ্যক মানুষের খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে। 

সম্পাদনা: রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞাকর্মী

সূত্র: বিবিসি

Blogger দ্বারা পরিচালিত.