জৈব যৌগের প্রাথমিক কথা
পৃথিবীতে আমরা অসংখ্য জীব দেখতে পায়, এসব জীব কি দিয়ে গঠিত?
রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন মৌল পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে এসব জীব গঠন করে। তবে সব জীব গঠনে যে মৌলটি প্রধান ভূমিকা পালন করে, তা হলো কার্বন। ৬ পারমাণবিক সংখ্যা বিশিষ্ট এই মৌলটি বিভিন্ন পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর বিভিন্ন আকারের যৌগ গঠন করে। এসব যৌগ জীবদেহ গঠন করে। পাশাপাশি কার্বন বহুরূপী ধর্ম প্রদর্শন করে। যেমন: একই কার্বন দিয়ে গঠিত কয়লা আবার হীরাও। কার্বনের বহুরূপী যৌগ শুধু প্রকৃতিতে নয়, জীবদেহের মধ্যেও তা লক্ষ্য করা যায়। তবে জীবদেহে থাকা কার্বনের প্রধান উৎস হলো বায়ুমন্ডল।
বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাইঅক্সাইড উদ্ভিদের দেহের মাধ্যমে জীবমন্ডলে প্রবেশ করে। উদ্ভিদ বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইডকে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অণু কার্বোহাইড্রেটে রূপান্তরিত করে। এরপর খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে তা এক জীব থেকে অন্য জীবে প্রবাহিত হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে জীবের বিভিন্ন ধাপে কার্বনের প্রবেশ ঘটে। এখানেই শেষ নয়। জীবের বিভিন্ন স্তরে কার্বন বিভিন্ন মৌল বা যৌগের সাথে যুক্ত হয়ে উচ্চতর জৈব যৌগ গঠন করে। আমরা যেসব মৌল বা যৌগ সম্পর্কে জানি, তাদের তুলনায় কার্বনের রাসায়নিক ধর্ম ভিন্ন। কার্বন বিভিন্ন জটিল, বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় যৌগ গঠন করতে পারে। সব জীব কার্বন দিয়ে গঠিত। তাই পৃথিবীতে আমরা এত বৈচিত্র্যময় জীব দেখতে পাই। কোনো জীবকে বিশ্লেষণ করলে যেসব যৌগ পাওয়া যাবে তার মধ্যে অন্যতম প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, লিপিড প্রভৃতি। এসব যৌগ গঠনের মূলে রয়েছে কার্বন। কার্বন বিভিন্ন পরমাণুর সাথে যুক্ত হয়ে এসব যৌগ গঠন করে। এমন কয়েকটি পরমাণু হলো হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার ও ফসফরাস। যে যৌগই গঠিত হোক না কেন তাদের ধর্ম কার্বনের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
যেসব যৌগ কার্বন দিয়ে গঠিত তাদেরকে জৈব যৌগ বলে। রসায়নের যে শাখায় এসব যৌগ নিয়ে আলোচনা করা হয় তা জৈব রসায়ন । বিজ্ঞানের এই শাখা জীব গঠনকারী ক্ষুদ্র যৌগ থেকে শুরু করে বৃহৎ জৈব যৌগ নিয়ে আলোচনা করে। সরল জৈব যৌগ হিসেবে মিথেন এবং বৃহৎ যৌগ হিসেবে প্রোটিনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ কথা স্পষ্ট যে জৈব যৌগে কার্বনের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। তবে এমনটি নয় যে শুধুমাত্র কার্বন দিয়ে জৈব যৌগ গঠিত হবে। কার্বনের সাথে অন্যান্য মৌল যেমন হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি যুক্ত থাকতে পারে। সাধারণত বৃহৎ জৈব যৌগের ক্ষেত্রে আমরা এমন গঠন বেশি দেখতে পাই। জৈব যৌগ গঠনের সাথে যুক্ত থাকে এমন কয়েকটি মৌল হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার এবং ফসফরাস। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন জীবদেহে এসব মৌলের শতকরা পরিমাণ প্রায় সমান। তবে অন্য মৌলের তুলনায় কার্বনের বহুরুপী যৌগ গঠন করে। ফলে কোন একটি জৈব যৌগের বিভিন্ন ধর্ম নির্ধারণে কার্বন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় দেখা গেছে অন্যান্য মৌলের সংখ্যা কম হলেও শুধুমাত্র কার্বনের গঠনের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন যৌগ তৈরি হচ্ছে। ফলে অন্যান্য মৌল সংখ্যায় কম হলেও কার্বন বৈচিত্র্যময় বিশাল আকৃতির জৈব যৌগ গঠন করতে পারে। এসব জৈব যৌগ বিশ্লেষণ করে একটি জীবকে অন্য জীব থেকে আলাদা করা যায়। আণবিক পর্যায়ের গবেষণার মাধ্যমে এই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এসব জৈব অণু দিয়ে একই জীবের বিভিন্ন প্রজাতি এমনকি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে আমরা পার্থক্য নির্ধারণ করতে পারি।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন জীবের সাথে পরিচিত। আদিম বুনো জীবন থেকে শুরু করে সভ্য সমাজ গঠন পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন জীবের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। নিজেরা জীব হয়েও আমরা চারপাশের বিশাল জীবজগতের উপর নির্ভরশীল। এমন কিছু জৈব উপাদান রয়েছে, যা আমরা সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করি। আবার অনেক জীবের উপর আমরা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। খাদ্য হিসেবে আমরা প্রতিদিন যা খেয়ে থাকি তা সব জৈব যৌগ। কার্বোহাইড্রেটেরে উৎস হিসেবে ভাত, রুটি; প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাংস, ডিম; লিপিডের উৎস হিসেবে চর্বি আমাদের নিত্যদিনের খাবার। আর জীবদেহ থেকে এসব পদার্থ বিশ্লেষণ ও তা নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জৈবরসায়নের যাত্রা শুরু। গবেষণার শুরুর দিকে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল শুধুমাত্র জীব থেকেই জৈব যৌগ পাওয়া যায়। অজৈব যৌগ থেকে গবেষণাগারে জৈব যৌগ প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। ১৮০০ সালের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উপাদান সঠিক মাত্রায় মিশ্রিত করে গবেষণাগারে সরল জৈব যৌগ প্রস্তুত করার কৌশল আয়ত্ত করেন। সরল যৌগ প্রস্তুত করতে পারলেও জটিল যৌগগুলোকে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব ছিল না। ফলে তখন জৈব যৌগ নিয়ে বিজ্ঞান মহলে বহু ধারণার জন্ম নেয়। বহু চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে সুইডিস রসায়নবিদ জন জ্যাকব বার্জেলিয়াসের ধারণা বিজ্ঞানী মহলে আলোচিত হয়। তার মতে, প্রাণ আছে এমন বস্তু অর্থাৎ সজীব বস্তু (যেমন: উদ্ভিদ ও প্রাণী) থেকে জৈব যৌগ উৎপন্ন হয়। অপরদিকে নির্জীব বস্তু (যেমন: মাটি,পানি,বালু প্রভৃতি) থেকে অজৈব যৌগ পাওয়া যায়। বার্জেলিয়াসের এ ধারণা প্রাণশক্তি মতবাদ নামে পরিচিত। এ মতবাদ স্থায়ী না হলেও জৈব রসায়ন নিয়ে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিল। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে জৈব যৌগ প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে জৈব যৌগ তৈরি করতে সক্ষম হন। ফলে প্রাণশক্তি মতবাদ টিকে থাকতে পারেনি। গবেষণাগারে জৈব যৌগ সংশ্লেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিডরিখ ভোলার। ১৮২৮ সালে তিনি একটি অজৈব লবণ প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন। তিনি অ্যামোনিয়াম আয়ন ও সায়ানেট আয়নকে মিশ্রিত করে অ্যামোনিয়াম সায়ানেট প্রস্তুত করেন। অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে তিনি একটি জৈব যৌগ ইউরিয়া প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে প্রাণির মূত্রে একই যৌগের উপস্থিতি দেখে তিনি বিস্মিত হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, গবেষণাগারে অজৈব যৌগ থেকে জৈব যৌগ প্রস্তুত করা সম্ভব। তিনি প্রাণশক্তি মতবাদ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি তার গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “আমি তোমাদের বলতে চাই যে, যকৃত বা প্রাণী (মানুষ বা কুকুর) ছাড়া আমি ইউরিয়া প্রস্তুত করতে পারি। তবে ইউরিয়া তৈরী করতে সায়ানেট নামক একটি যৌগ ব্যবহার করা হয়। কোন প্রাণির রক্ত থেকে এই যৌগটি নিষ্কাশন করা হয়। তিনি স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা সম্পন্ন করেন। এছাড়াও তিনি প্রমাণ করেন যে, জৈব যৌগ উৎপাদনে প্রাণশক্তি মতবাদের কোন প্রভাব নেই। এর কয়েক বছর পর ভোলারের ছাত্র হারম্যান কল্ব অজৈব যৌগ থেকে অ্যাসিটিক এসিড প্রস্তুত করেন। পরবর্তী কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে অনেকগুলো জটিল জৈব যৌগ প্রস্তুত করেন। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে যে গবেষণাগারে জৈব যৌগ তৈরি করা সম্ভব।
প্রাণরসায়ন সম্পর্কে আরোও জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে ‘ক্যাম্পবেল বায়োলজি
(প্রাণরসায়ন ইউনিট) বইটি পড়ুন। বইটি সংগ্রহ করতে নিচের ছবিটিতে ক্লিক করুন:-