-->

চুকুরের নতুন জাত বিজেআরআই মেস্তা ৪ (সব্জি মেস্তা ২): পরিচিতি ও চাষাবাদ পদ্ধতি

 ফুলে ফলে ভরা সবুজের লীলাভূমি বাংলাদেশ। ফসলের জন্য উর্বর ভূমি ও প্রাকৃতিক অনুকূলতার কারলে আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকার ফসল আবাদ হয়। ফলে দানাদার, তৈলজাতীয়, মসলাজাতীয়, সবজি ও ফলের আবাদ দেখি আমরা প্রতিনিয়ত। মানুষের চাহিদা মাথায় রেখে আবাদ হচ্ছে বিভিন্ন রকম ফসল। বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করছেন বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত ও প্রযুক্তি। মেস্তা এমন একটি উদীয়মান ফসল। এটি উপগুল্ম জাতীয় আঁশফল। মেস্তার আদি নিবাস পশ্চিম আফ্রিকা বলে মনে করা হয়। অনেকে মনে করেন ভারতবর্ষে মেস্তার উৎপত্তি।উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক থাকলেওএশিয়া  ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মেস্তা চাষ করা হয়। প্রচলিত মেস্তা দুই প্রকারঃ ১) আঁশের জন্য ব্যবহৃত মেস্তা ২) সব্জির জন্য ব্যবহৃত মেস্তা। আঁশের জন্য চাষকৃত মেস্তার কান্ড সোজা, শাখা-প্রশাখা হয় না, দন্ডাকৃতির, উচ্চতা ৩-৪ মিটার। অন্যদিকে সবজির জন্য চাষকৃত মেস্তার কান্ড শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট, ঝোঁপালো, খাটো, উচ্চতায় ১-২ মিটার। 


সব্জি মেস্তার পাতা শাক হিসেবে ও এর মাংসল বৃতি কনফেকশনারী খাদ্য সামগ্রী যেমন চা, জ্যাম, জেলী, জুস, আচার, ড্রাইফুট ইত্যাদি তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি প্রায় ৬ গ্রাম ওজনের ফল থেকে প্রায় ৩ গ্রাম মাংসল বৃতী পাওয়া যায়। সব্জী মেস্তার মাংসল বৃতি ৩ ধরণের হয়-গাঢ় লাল, লালচে সবুজ  এবং সবুজ। তবে এর আকর্ষণীয় মেরুন লাল রং ও টক মিষ্টিস্বাদের জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয় এবং খাদ্য হিসেবে এটি খুবই জনপ্রিয়।

বিজেআরআই মেস্তা ৪ মেস্তা উদ্ভাবনের ইতিহাস

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (Local race) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন করে। অতপর গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী একটি উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে, যা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ২০২২ সালে বিজেআরআই মেস্তা ৪ (সব্জি মেস্তা ২) নামে অবমুক্ত করা হয়।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে পরিচিত হলেও মেস্তার জনপ্রিয় নাম ‘চুকাই’ বা ‘টকফল’ এবং ইংরেজি নাম ‘রোজেলা’। এর পাতা  ও ফলের মাংসল বৃতি টক এবং সুস্বাদু।

বিজেআরআই মেস্তা ৪ কিভাবে চিনবেন?

সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যঃ গাছের কান্ড সবুজ, পর্ব বেগুনী, পাতা সবুজ, কম খন্ডিত এবং কিনারা ঢেউ খেলানো, বোটার দুই প্রান্ত গাঢ় লাল, ফুল ক্রিম রং, ভিতরের মাঝখানে গাঢ় খয়েরী রঙের, ফল লালচে সবুজ ও লম্বাটে, বীজ কিডনি আকারের ও ধূসর রঙের।


চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যঃ এ জাতের গাছ খাটো, শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট ও ঝোপালো। ঘন করে বপন করলে শাখা-প্রশাখা কম হয়। কান্ড ও পাতায় কোনো কাঁটা থাকে না।

সব্জি মেস্তা-২ এর ব্যবহার ও পুষ্টি উপাদান

মেস্তার পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি টক স্বাদযুক্ত ও খাওয়ার উপযোগী। কচি পাতা সরাসরি ছালাদ হিসেবে অথবা রান্না করে সবুজ শাক হিসেবে অথবা অন্য সবজির সাথে মিশিয়ে রান্না কর খাওয়া যায়। কচি পাতা ও মাংসল বৃতি অন্য তরকারির সাথে মিশিয়ে খাবারের স্বাদ বাড়ানো যায়। সব্জি মেস্তার ফলের মাংসল বৃতি খুবই জনপ্রিয়। এর পাতা ও ফল বিভিন্ন খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। এটি জুস, জ্যাম, সিরাপ, পুডিং, কেক এবং আইসক্রিম তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। শুকনো বৃতি পানীয়, সচ, আচার/চাটনী এবং অন্যান্য ফলাহারে ব্যবহার করা হয়। মেস্তার ফুলের উপবৃতিতে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন-সি এবং বি-কমপ্লেক্স থাকে। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরীতে এই উপাদানগুলো সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া মানবদেহের রক্ত চাপ কমানো, হজম শক্তি বৃদ্ধি, পরিপাকতন্ত্র সচল রাখা, ঠান্ডা জনিত রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধে এটি ব্যবহৃত হয়। সব্জি মেস্তা-২ এর প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো পাতা ও ফলের বৃতিতে পুষ্টি উপাদান ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ নিম্নরূপ:-


পুষ্টি উপাদান

পাতা (১০০ গ্রাম শুকনো)

বৃতি (১০০ গ্রাম)

আর্দ্রতা

১১.৮৩ গ্রাম

১২.৯৩ গ্রাম

অ্যাশ (ছাই)

১১.৬১ গ্রাম

৭.০৭ গ্রাম

শর্করা

৫২.৫৮ গ্রাম

৭৩.২৯ গ্রাম

প্রোটিন

১৪.৪৪ গ্রাম

৪.৩৮ গ্রাম

আঁশ (ফাইবার)

২৮.১৮ গ্রাম

১৩.৯১ গ্রাম

স্নেহ

৭.০৯ গ্রাম

০.৭৩ গ্রাম

সোডিয়াম

০.৩০৪ গ্রাম

০.৪২৬ গ্রাম

পটাসিয়াম

০.৯৭৩ গ্রাম

০.৯৭৩ গ্রাম

ক্যালসিয়াম

১.৭৫ গ্রাম

১.১০ গ্রাম

ম্যাগনেসিয়াম

০.২৫২ গ্রাম

০.২৫২ গ্রাম

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান

পাতা

বৃতি

ফেনল

৩১৩.৯৬ মিলিগ্রাম

৪১৮.১৪ মিলিগ্রাম

ফ্ল্যাভিনয়েড

২২.০৫ মিলিগ্রাম

৩৬.৫২ মিলিগ্রাম

প্রোঅ্যান্থোসায়ানিডিন

৪৫.৪৭ মিলিগ্রাম

৯.২৮ মিলিগ্রাম

অ্যান্থোসায়ানিন

-

৮৫.৮৯ মাইক্রোগ্রাম

 চাষ উপযোগী জমি

উচু ও মাঝারি উচু জমি যেখানে বৃষ্টির পানি জমে  থাকে না। দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি এ জাতের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযোগী। এছাড়া বাড়িও আঙিনা ও অনাবাদি প্রান্তিক জমিতে চাষ করেও ভালো ফলন পাওয়া যায়।

বপন কাল

সব্জি মেস্তা ২ মধ্য চৈত্র থেকে আশ্বিন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ) মাস অবধি বপন করা যায়। তবে উত্তম সময় হলো ১৫ই জৈষ্ঠ থেকে ১৫ই শ্রাবণ (জুন থেকে জুলাই)।

 জমি তৈরী ও বীজ বপন

জমির প্রকারভেদে আড়াআড়ি ৩-৪ বার চাষের পর ২-৩ বার মই দিয়ে জমির মাটি মিহি করা প্রয়োজন। এছাড়া আশানুরুপ বীজ গজানোর লক্ষ্যে জমি আগাছামুক্ত করা প্রয়োজন। ছিটিয়ে ও সারিতে উভয় পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দুরুত্ব ৩০-৪০ সে.মি. এবং গাছ থেকে গাছের দুরুত্ব হবে ৮-১০ সে.মি.। সারিতে বপন করে গাছের যত্ন নেওয়া সহজ হয়, ফলন বৃদ্ধি পায়।

 বীজের পরিমাণ

ছিটিয়ে বপন করলে প্রতি হেক্টরে ১৮-২০ কেজি এবং সারিতে বপন করলে ১৪-১৫ কেজি পরিমাণ বীজ প্রয়োজন হয়।

 সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

সব্জি মেস্তা ২ আবাদে সার প্রয়োগে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:-

১) জমি তৈরীর সময় হেক্টর প্রতি ২-৩ টন গোবর সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। গোবর সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।

২) গোবর সার প্রয়োগ না করলে হেক্টর প্রতি ৬৬ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি, ৪০ কেজি এমওপি সার জতি তৈরীর সময় প্রয়োগ করতে হবে।

৩) বীজ বপনের ৪৫ দিন পর হেক্টর প্রতি ৬৬ কেজি ইউরিয়া ছিটিয়ে দিলে পাতা, ফল ও বীজের মান ভালো হয়। ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সার গাছের পাতায় লেগে না থাকে।

 পরিচর্যা 

বীজ বপনের ১-২ সপ্তাহ পর জমির জোঁ অনুযায়ী আঁচড়া দিতে হবে। এসময় প্রয়োজনে চারার সংখ্যা বেশি হলে পাতলা করে দিতে হবে। গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে একবার নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে সুস্থ সবল গাছ রেখে দুর্বল ও চিকন গাছ তুলে ফেলতে হবে। সাধারণত গাছের রোগ বালাই দেখা দিলে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

পাতা ও বৃতি (ক্যালিক্স) সংগ্রহ

গাছের বয়স ৬০-৬৫ দিন হলেই তখন থেকে শাক সংগ্রহ করা যায়। পাতলাকরণ এর সময় গাছ তুলে এবং ৩ মাস বয়স পর্যন্ত গাছের পাতা শাক হিসেবে সংগ্রহ করা যায়। বীজ বপনের ১২০-১৮০ দিন পর মেস্তার ফুল আসা আরম্ভ হয়। ফুল আসার ৪০-৪৫ দিন পর ফল পরিপুষ্ট হলে ফল সংগ্রহ করা যায়। সংগ্রহকৃত মাংসল বৃতি রোদে শুকিয়ে সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী তৈরীর জন্য কনফেকশনারীতে প্রেরণ করা হয় বা রান্না করে খাওয়া যায়।

 বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ

অন্যান্য ফসলের মতো স্বাভাবিক প্র্রক্রিয়ায় বীজ উৎপাদন করা যায়। এটি স্ব-পরাগায়িত ফসল, সেহেতু বীজ উৎপাদনে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। স্বাভাবিক বপনের সময় বীজ বপন করে ফল থেকে বীজ উৎপাদন করা যায়। তবে মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য আশ্বিন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত একটু উঁচু জমিতে বীজ বপন করলে ভালো মানের বীজ পাওয়া যায়।

মেস্তার ফল পাঁকলে ফসল কর্তন করে ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নিলে ফলগুলো ফেটে যায়, তারপর লাঠি দিয়ে মাড়িয়ে সহজে বীজ সংগ্রহ করা যায়। বীজ শুকানোর জন্য সরাসরি সিমেন্টের মেঝের উপর না রেখে মেঝের উপর পাটের বস্তা বিছিয়ে অথবা গোবর দিয়ে লেপে কাঁচা উঠানে শুকানো ভালো। সিমেন্টের মেঝেতে অধিক তাপে বীজের ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দাঁত দিয়ে চাপ দিলে কট করে শব্দ হলে বুঝতে হবে বীজ ভালোভাবে শুকিয়েছে। এরপর শুকনো বীজ ঠান্ডা করে প্লাস্টিকের ক্যান, টিন ইত্যাদিতে রেখে ভালোভাবে মুখ বন্ধ করে রাখলে বীজ বহুদিন ভালো থাকে।

 ফলন

মাটির টব বা ফাঁকা জায়গায় পাতলা করে বীজ বপন করলে চুকুরের একটি গাছে ৬০-১০০ টি ফল ধরে। তবে ৪০ সে.মি. দুরে দুরে সারিতে বীজ বপন করলে এবং গাছ থেকে গাছের দুরুত্ব ১০০ সে.মি. হলে গাছ প্রতি ১৫-২০ টি ফল ধরে এবং হেক্টর প্রতি ২-২.৫ লক্ষ গাছ থেকে ৪০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ ফল ধরে।

 

সূত্র: বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট

কৃতজ্ঞতা: মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন, প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট

 

 

 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.