ধানের রোগ চেনার সহজ উপায়!
বাংলাদেশের আবাদী জমির সিংহভাগ দখল করে আছে ধান। প্রতিনিয়ত আমাদের খাবারের টেবিলের দেখা মেলে। ফলে দেশের একটি বিশাল অংশ ধান চাষের সাথে জড়িত। ধান চাষের ক্ষেত্রে রোগ পোকামাকড়ের আক্রমণ একটি সাধারণ বিষয়। ফলে রোগ-পোকামাকড় দমনে কৃষককে সঠিক প্রস্তুতি নিতে হয়। অনেক সময় ধানের জমিতে রোগের আক্রমণ হলে সহজে বুঝতে পারা যায় না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ধান গাছে দেখা যায় এমন রোগগুলো সহজে চেনার উপায় প্রকাশ করেছেন। নিম্নে প্রদত্ত এসকল লক্ষণ দেখে খুব সহজে আপনি ধানের রোগ সনাক্তকরণ ও তা সমাধানে সঠিক পরামর্শ প্রদান করতে পারবেন।
১) ব্লাস্ট:
ধানের রোগগুলোর মধ্যে সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় নাম ব্লাস্ট। সাধারণত গাছের পাতা, কান্ড এবং শীষে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত গাছের পাতায় চোখের ন্যায় গোলাকার বা ত্রিকোণাকৃতির দাগ দেখা যায়। দাগের কেন্দ্রীয়ভাগ সাদা বা ধূসর এবং চারদিকে বাদামি। শীষ আক্রান্ত হলে শীষ সম্পূর্ণ সাদা, শীষের গোড়া পচে গাঢ় বাদামী বা কালচে দাগ হয়, শীষ টান দিলে সহজে উঠে আসবে না। দুধ অবস্থায় আক্রান্ত হলে শীষ ভেঙ্গে ঝুলে থাকবে এবং শীষের ধান অপুষ্ট হবে। কান্ড আক্রান্ত হলে কান্ডের গিঁটে কালো দাগ দেখা যায়।
২) খোলপোড়া রোগ: ধান গাছের গোড়া থেকে উপরের দিকে খোল ও পাতায় গোখরা সাপের
মতো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।
৩) বাকানি রোগ: বাকানি রোগে আক্রান্ত হলে ধান গাছ বা কুশি জমির অন্যান্য
ধান গাছের চেয়ে লম্বা, লিকলিকে হয় এবং হালকা সবুজ বর্ণের হয়ে যায়। মাটির উপরিভাগে গাছের
কান্ডের গিঁটে শিকড় জন্মে।ছবি: ধানের খোলপড়া রোগ, ছবি সংগৃহিত
ছবি: ধানের বাকানী রোগ, ছবি-সংগৃহিত
৪) কান্ডপচা রোগ: সাধারণত জমির পানির তল বরাবর ধান গাছের বাইরের খোলে এই রোগের আক্রমণ শুরু হয়। দাগগুলো কালো আয়তাকার। বাইরের খোলে আক্রমণ শুরু করলেও পরবর্তীতে ভিতরের খোলে, এমনকি কান্ডের ভিতরের দিকে এই দাগগুলো অগ্রসর হয়। অতি মাত্রায় আক্রান্ত হলে আক্রান্ত অংশ কালো হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। কান্ড ভাঙলে/ছিঁড়লে ছোট কালো গোল গুটি দেখা যায়।
ছবি: ধানের কান্ডপঁচা রোগ, ছবি-সংগৃহিত
৫) খোলপচা: এই রোগে আক্রান্ত ধান গাছের ডিগপাতার খোলে অনেকগুলো কালো দাগ
একত্রিত হয়ে পচে কালো রঙ ধারণ করে। ধান গাছের শীষ আংশিক বের হয় এবং উৎপাদিত ধানের অধিকাংশ
কালো দাগযুক্ত হয়।
৬) চারা ঝলসানো/চারাপোড়া রোগ: সাধারণত শীতকালে বোরো ধানের বীজতলায় এই রোগ
দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত বীজতলায় অঙ্কুরিত বীজ ও চারা বাদামি রঙের হয়, সাদা ছত্রাকের
উপস্থিতি দেখা যায়। ধীরে ধীরে আক্রান্ত চারাগুলো মারা যায়। ছবি: ধানের খোলপঁচা রোগ, ছবি-সংগৃহিত
ছবি: ধানের চারা ঝলসানো, ছবি-সংগৃহিত
৭) চারাধ্বসা রোগ: শীতকালে বোরো বীজতলায় পানি জমে স্যাঁতসেঁতে থাকলে অঙ্কুরিত চারা সবুজ ছত্রাক দ্বারা আবৃত হয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়। আক্রান্ত স্থানের মাটিতে মরিচা পড়ার মতো রঙ দেখা যায়।
৮) পাতাঝলসানো/পাতাপোড়া রোগ: ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে। ঝড়
বৃষ্টির পর গাছে ক্ষত তৈরী হলে দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে পাতার শীর্ষে অথবা কিনারায় হলুদাভাব
দাগ সৃষ্টি হয়। পরে পাতার উপর থেকে ক্রমশ নিচের দিকে এবং পাতার দুই কিনার হতে ভিতরের
দিকে হলুদাভাব দাগ বৃদ্ধি পায় যা পরে দেখতে খড়ের মতো হয়। ছবি: ধানের পাতা ঝলসানো রোগ, ছবি-সংগৃহিত
৯) পাতার লালচে রেখা: এই রোগে আক্রান্ত পাতার শিরা বরাবর লম্বালম্বি স্বচ্ছ
দাগ হয়, অসংখ্য হলদে জীবাণু গুটি হয় যা পরে কমলা হলদে রঙ ধারণ করে। আক্রান্ত পাতা সূর্যের
বিপরীতে ধরলে আলো দেখা যায়। ছবি: পাতার লালচে রেখা, ছবি-সংগৃহিত
১০) উফরা রোগ: ধান গাছের বর্ধিষ্ণু অংশে এই রোগের আক্রমণ শুরু হয়। এখান
থেকে গজানো নতুন পাতার গোড়ার দিকে ছিটোফোঁটা সাদা দাগ দেখা যায়। শীষ বের হতে পারে না,
আর বের হলেও শীষ কুঁকড়ানো ও শীষে ধান কম পুষ্ট হয়। ছবি: ধারে উফরা রোগ, ছবি-সংগৃহিত
১১) শিকড়গিঁট : বেলে ও বেলে-দোআঁশ মাটিতে এই রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত গাছের শিকড়ে গিঁট হয় বিধায় মাটি হতে প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে গাছ খাদ্যের অভাবে হলুদাভাব রঙ ধারণ করে এবং গাছ খাটো হয়ে যায়। পাতায় বাদামি দাগ দেখা যায়।
১২) টুংরো রোগ: এই রোগে আক্রান্ত জমির ধান গাছ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায়
কমলা-হলুদ রঙ ধারণ করে। সুস্থ গাছের তুলনায় এই রোগে আক্রান্ত গাছে কুশির সংখ্যা কম
হয় এবং খাটো হয়। নাইট্রোজেন ও গন্ধক সার ব্যবহার
করেও এই হলুদাভাব রঙ দুর হয় না। গাছে সবুজ পাতা ফড়িংয়ের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।ছবি: ধানের টুংরো রোগ, ছবি-সংগৃহিত
১২) নাইট্রোজেনের অভাব: ধানের জমিতে সব জায়গা হলদে গাছ দেখা যায়। বিক্ষিপ্তভাবে
কোথাও কোথাও হলুদ এমনটি নয়। ইউরিয়া দিলে সবুজ হয়। ছবি: নাইট্রোজেনের অভাবজনিত লক্ষণ, ছবি-সংগৃহিত
১৩) গন্ধকের অভাব: পুরো জমিতে ধান গাছের কচি পাতা হলদে বা হালকা হলদে বিবর্ণতা দেখা যায়। তবে মাঠের নিচু জায়গার গাছে বেশি দেখা যায়। জিপসাম প্রয়োগ করলে দূর হয়।
১৪) দস্তার অভাব: ধান গাছের পাতায় মরচে পড়া হলদে বা বাদামি হলদে দাগ, মধ্য শিড়ার দুদিক বরাবর সাদা সাদা অংশ ,গাছ কিছুটা খাটো, শিকড় পরিষ্কার বা সাদা বর্ণের, মাঠের নিচু জায়গায় বেশি লক্ষণ দেখা যায়। জিংক সালফেট প্রয়োগে দূর হয়।
সূত্র: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট