কলার পূর্বপুরুষের ধাঁধাঁয় বিজ্ঞানীরা
কলা পছন্দ করে না এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত হাতেগোনা। একটা সময় ছিল যখন দুধ ভাত আর কলা না হলে রাতের খাবার জমতো না। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকার কলা দেখা যায়। বিচি কলা, সবরি কলা, মদনা কলা, সাগর কলা এমন অসংখ্য কলা আবাদ হয় বাংলাদেশে। আজ যে কলা আমরা ভক্ষণ করি তা কি প্রথম থেকেই এমন ছিল? মানুষ তার স্বভাবজাত কৌতুহল থেকে ফসলের উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে চাই। একইসাথে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ফসলের আদি জাত, তাদের উৎপত্তি, বিস্তৃতি সম্পর্কে জানার জন্য গবেষণা করছেন। এরই ধারাবাহিকতা বিজ্ঞানীরা কলার পূর্বপুরুষ জানার চেষ্টা করেছেন। একশর বেশি বুনো ও আবাদী কলার জাত নিয়ে জীনতাত্ত্বিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এক জটিল রহস্য উন্মোচন করেছেন। গবেষণায় বর্তমানে আবাদী কলার পূর্বপুরুষের জটিল ধাঁধার সমাধান করেছেন। পাশাপাশি পূর্বে অজানা ছিল এমন তিনটি কলার জাতের সন্ধান পাওয়া গেছে। কলা বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার সূত্র ধরে ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিচালনা করতে চান। তার ফলে হয়তো অধিক উন্নত ও রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে।
ছবি: বিচিযুক্ত বুনো কলা, সায়েন্স |
বিজ্ঞানীদের মতে কলার আদিপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত জাত হলো Musa acuminate. এটি একটি বুনো জাত, ভারত থেকে অস্ট্রোলিয়া অবধি এই জাতের বিস্তৃতি রয়েছে। তবে কলার প্রথম চাষ শুরু হয় পাপুয়া নিউগিনিতে। বর্তমানে যে কলার চাষ হয় তার প্রথম যাত্রা শুরু যে পাপুয়া নিউগিনিতে, তা অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন। বর্তমানে আবাদকৃত কলার জাতের সংখ্যা ১০০০ এর চেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের প্রতিনিয়ত গবেষণা ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে প্রাচীন বিচি ও স্বাদহীন কলা বর্তমানে বিচিমুক্ত, রসালো হয়েছে। ফলে বর্তমানে সুপারমার্কেটসহ সাধারণ বাজারে আমরা রকমারি সুস্বাদু কলা দেখতে পায়। তবে আধুনিক কলার আবাদ ঠিক কখন শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত করা কঠিন। এবিষয়ে সত্যিকার তথ্য উদঘাটন করা মুশকিল। বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেমে নেই। প্রাচীন জাত থেকে আজ অবধি বিভিন্ন কলার জাতের ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। কলার জীনতাত্ত্বিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা চমকপ্রদ তথ্য উদঘাটন করেছেন। দেখা গেছে কিছু কলার জাতে দুইসেট ক্রোমোসোম আছে, আবার কিছু জাতের কলায় তিন সেট ক্রোমোসোম আছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে, বর্তমানের আবাদী কলার মধ্যে কিছু হাইব্রিড কলার জাত আছে যারা একাধিক জাত বা একাধিক প্রজাতির মধ্যে আন্তঃসংকরায়নের মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে।
ছবিঃ Musa acuminate |
ছবিঃ ক্যাভেন্ডিস ব্যানানা |
বিজ্ঞানীরা পানামা ও ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট প্রতিরোধী বন্য কলার জাত অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। সাধারণত কোনো ফসলের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কিছু জাত পাওয়া যায় যারা নির্দিষ্ট রোগ প্রতিরোধী হতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধী জীন বর্তমানে আবাদী জাতে ট্রান্সফার করতে রোগহীন কলা পাওয়া সম্ভব হবে। মূলত জীনতাত্ত্বিক গবেষণায় জীন ট্রান্সফার বা মিউটেশনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা কোনো ফসলের রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেন। এলক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা কলার পূর্বপুরুষদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।
কলার জিনোম নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন বিজ্ঞানী হলেন নাবিলা ইয়াহিয়া। ফ্রান্সের মন্টিপিলার শহরে অবস্থিত ফ্রেন্স এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের গবেষক তিনি। নাবিলা ও তার সহকর্মীরা ২৪ প্রজাতির আবাদী ও বুনো কলার ডিএনএর মধ্যে তুলনা করেছেন। কিছু কিছু জাতের ক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু ফলাফল পেয়েছেন যা সত্যিকারভাবে ধাঁধাঁর জন্ম দিয়েছে। কয়েক প্রজাতির কলা পাওয়া গেছে যাদের ডিএনএর সাথে অন্য কোনো প্রজাতির ডিএনএর কোনো মিল নেই। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে ২০২০ সালে তারা আধুনিক আবাদী কলার পূর্বপুরুষ হিসেবে নতুন একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, বর্তমানে আবাদী কলার ডিএনএর সাথে M. acuminate ও অন্যান্য বন্য জাত ছাড়াও অজানা দুইটি প্রজাতির ডিএনএর মিল রয়েছে।
এলিয়েন্স অব বায়োডাইভারসিটি ইন্টারন্যাশনালের বিজ্ঞানী জুলি সারডস ও তার সহকর্মীরা নতুন একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন। তারা প্রধানত দুই সেট ক্রোমোসোম আছে এমন কলার জাতের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কারণ এসকল জাতের সাথে প্রথম আবাদী কলার যথেষ্ট মিল রয়েছে। অন্যদিকে ক্যাভেন্ডিস কলার ডিএনএতে তিন সেট ক্রোমোসোম বিদ্যমান। গবেষণার অংশ হিসেবে তারা ৬৮ টি বুনো জাতের কলার নমুনা এবং ১৫৪ প্রকার বর্তমানে আবাদী কলার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন। তাদের গবেষণায় ব্যবহৃত আবাদী কলার মধ্যে ২৫ টি নমুনা পাপুয়া নিউগিনি থেকে সংগ্রহ করা হয়। একটি সমৃদ্ধ গবেষণার জন্য সত্যি এটি একটি অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা। অস্ট্রোলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ টিম ডেনহাম এই গবেষণা সম্পর্কে বলেন, “সত্যি, এই গবেষণায় নমুনা সংগ্রহ আমাকে অভিভূত করেছে কারণ এমন কিছু জাতের নমুনা রয়েছে যা সংগ্রহ করা খুবই কষ্টসাধ্য”।
তাদের গবেষণায় কলার পূর্বপুরুষ ও চাষাবাদ সম্পর্কে আরোও নির্ভরযোগ্য তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। এটা স্পষ্ট করেছে যে, পাপুয়া নিউগিনিয়াতে প্রথম কলার চাষ শুরু হয়। M. acuminate প্রজাতির একটি উপ-প্রজাতি যা স্থানীয়ভাবে ‘বাঙ্কিসা (banksia)’ নামে পরিচিত। এই বাঙ্কিসা কলা আবাদের মধ্য দিয়ে কলা চাষের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই উপ-প্রজাতিটি রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, যা এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। জুলি সারডস ও তার সহকর্মীদের গবেষণাপত্র চলতি মাসে Frontiers in Plant Science জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
তাদের গবেষণায় বর্তমানে চাষযোগ্য কলায় বিদ্যমান তৃতীয় অজানা জীনের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করেছে। তবে এখন বিজ্ঞানীদের এই তিন প্রকার জীনধারণকারী প্রজাতি সনাক্ত করতে হবে। যদিও সারডস ও সহকর্মীদের গবেষণায় এই তিন প্রজাতির কলার উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাদের মতে, একটি প্রজাতি এসেছে নিউ গায়ানা থেকে, অন্যটি থাইল্যান্ডসহ গালফ দেশগুলো থেকে এবং উত্তর বোর্নিও ও ফিলিওপাইন অঞ্চলের কোনো অংশ থেকে তৃতীয় প্রজাতি উৎপত্তি লাভ করেছে।
সারডসদের এই প্রাপ্তি কলা গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানী মহলে তাদের গবেষণা সমাদৃত হয়েছে। তাদের গবেষণা নিয়ে বিজ্ঞানী রায়েসবার্গ বলেন, “সারডসদের গবেষণা কিছু ফসলের বিবর্তনে সংকরায়নের ভূমিকা রয়েছে তা আমাদেরকে নিশ্চিত করেছে”।
তবে সারডসদের গবেষণা এখানে শেষ নয়। কলা নিয়ে জীনতাত্ত্বিক গবেষণার আকাশে এটি নতুন সুর্যোদয়। সারডস, তার সহকর্মীরা এবং অন্যান্য কলা প্রেমীরা এখন বিভিন্ন কলার বাগান পরিদর্শন করবেন। কলার পূর্বপুরুষ রয়েছে এমন অঞ্চল ভ্রমণ করবেন, আরোও আধুনিক জাত উদ্ভাবনে গবেষণা করবেন। কলা বাণিজ্যকে আরোও ফলপ্রসূ করতে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী জীন অনুসন্ধান করবেন বিজ্ঞানীরা।
সূত্র: সায়েন্স
সংকলনঃ
রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞান কর্মী ও সংগঠক। ২০০৭ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিজ্ঞান আন্দোলন ও লেখালেখির সাথে জড়িত। বাংলাদেশ বায়োলজি অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী কোচ। বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কর্মরত। সম্পাদিত বই: ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট), ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট), বীজগণিত সমগ্র (১ম ও ২য় খন্ড) ।