-->

কোষবিদ্যা-০৫: মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট

 

কোষের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে জীবদেহ সচল থাকে। কোষের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গাণুর রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো জীবদেহের কার্য সম্পাদিত হয়। ইঞ্জিন কাজ করতে যেমন শক্তি প্রয়োজন, তেমনি কোষের কাজ সম্পাদনের জন্য শক্তির প্রয়োজন। কোষের মধ্যে এমন কিছু অঙ্গাণু রয়েছে, যারা কোষের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে বা রূপান্তর ঘটায়। আমরা জানি, সৌর জগতের সকল শক্তির উৎস সূর্য, সেখান থেকে আগত শক্তি বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে বিভিন্ন রূপে প্রকৃতিতে বিদ্যমান।

আমরা কোষের শক্তি উৎপাদনকারী অঙ্গাণু সম্পর্কে জানবো। মূলত কোষের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গাণু সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো থাকে। প্রতিটি অঙ্গাণু নির্দিষ্ট কাজ করে। বিভিন্ন অঙ্গাণুর সম্পাদিত কাজের মধ্যকার সমন্বয়ের মাধ্যমে পুরো কোষের কাজ সম্পন্ন হয়। একটি ইউক্যারিওটিক কোষের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয় মাইটোকন্ড্রিয়া ও নিউক্লিয়াস। মূলত এই অঙ্গাণু দুটি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় শক্তি রূপান্তর ঘটায়। মাইটোকন্ড্রিয়া হলো শ্বসন অঙ্গ। একে শক্তির পাওয়ার হাউজ বলা হয়। এটি কোষের বিভিন্ন উপাদানকে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে শ^সন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি তথা এটিপি উৎপন্ন করে। তবে প্রোক্যারিওটিক কোষে অক্সিজেন ছাড়াও শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যেহেতু আমরা এখানে ইউক্যারিওটিক কোষ নিয়ে আলোচনা করছি তাই অক্সিজেনের উপস্থিতিতে শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

অপরদিকে ক্লোরোপ্লাস্ট হলো উদ্ভিদ বা শৈবালে অবস্থানকারী সালোকসংশ্লেষী অঙ্গাণু। এটি সূর্যের আলো ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানিকে শর্করায় রূপান্তর করে। এই প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ শক্তির উৎস সূর্য থেকে সৌরশক্তি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক শক্তিরূপে উদ্ভিদের কোষে জমা হয়। অপরদিকে মাইটোকন্ড্রিয়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিতে রূপান্তরিত করে যা কোষ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে।  দেখা যাচ্ছে কাজের দিক দিয়ে এই দুইটি অঙ্গাণুর মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। জৈব অভিব্যক্তির ধারায় সব কোষের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করলে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে বিশেষ মিল খুজে পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা ক্লোরোপ্লাস্ট ও মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও কাজের মধ্যে মিল খুজে পেয়েছেন। জৈব অভিব্যক্তির ধারায় ক্লোরোপ্লাস্ট ও মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজতে গিয়ে আমরা পারআক্সিসোমকেও বিবেচনায় নিতে পারি। পারঅক্সিসোম হলো বিশেষ প্রকার শ্বসন অঙ্গাণু। ধারণা করা হয় অন্যান্য শক্তি রূপান্তরকারী অঙ্গাণুর সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখনও বিতর্ক চলছে। 

মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের উৎপত্তি: এন্ডোসিমবায়োন্ট তত্ত্ব

জীবদেহের প্রতিটি কোষের মধ্যকার অঙ্গাণুসমূহের কাজের প্রক্রিয়া বেশ জটিল, অনেকটা ধাঁধার মতো। তবে এদের উৎপত্তি ও মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়গুলো সত্যিই রোমাঞ্চকর। বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলো নিয়ে সর্বাধিক গবেষণা হয়েছে তার একটি হলো জৈব অভিব্যক্তি। জৈব অভিব্যক্তিক ধারায় দেখা গেছে শুধু জীব নয়, কোষের মধ্যে থাকা অঙ্গাণুসমূহের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। কিভাবে প্রোক্যারিওটিক কোষ থেকে ইউক্যারিওটিক কোষের উৎপত্তি হয়েছে? তা যেন জীববিজ্ঞান গবেষণার এক বিস্ময়কর বিষয়। দেখা গেছে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে। এটি কোষের মধ্যে অবস্থিত এমন দুইটি অঙ্গাণু যার একটি সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে শর্করা উৎপন্ন করে (উদ্ভিদকোষের ক্লোরোপ্লাস্ট)। অপরদিকে মাইটোকন্ড্রিয়া শর্করা ভেঙে শক্তি উৎপাদন করে যা কোষের বিভিন্ন ক্রিয়া সম্পাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রোক্যারিওটিক কোষ থেকে ইউক্যারিওটিক কোষের উৎপত্তি এন্ডোসিমবায়োন্ট তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখা করা যায়। জৈব অভিব্যক্তির আলোকে জীবের উৎপত্তি সম্পর্কিত বহুল আলোচিত তত্ত্ব এটি। এর মাধ্যমে উৎপত্তিগতভাবে মাইটোকন্ড্রিয়া ও কেøারোপ্লাস্টের সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে। ইউক্যারিওটিক কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনার আগে এই তত্ত্বের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১৯৬০ সালে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী লিন মারগুলিস এন্ডোসিমবায়োন্ট তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে এটি বিজ্ঞান মহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিমবায়োসিস (মিথোজীবীতা) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে দুটি জীব পাশাপাশি অবস্থান করে এবং পুরো জীবন চক্রে একটির উপর অন্যটি নির্ভর করে। ন্ডোসিমবায়োন্ট শব্দটি সিমবায়োন্ট থেকে কিছুটা ভিন্ন। এক্ষেত্রে দুইটি জীব বা অঙ্গাণু পারস্পারিক ক্রিয়া সম্পাদনের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে। তবে এক্ষেত্রে একটি জীবের বা অঙ্গাণুর মধ্যে অন্যটি অবস্থান করে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে জৈব অভিব্যক্তির ধারায় মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ধারণা করা হয় এন্ডোসিমবায়োসিস প্রক্রিয়ায় এক প্রকার প্রোক্যারিওটিক (আদি) ব্যাকটেরিয়ার দেহে ইউক্যারিওটিক কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া উৎপন্ন হয়েছে। এই ব্যাকটেরিয়া স্বভোজি অর্থাৎ নিজের খাদ্য নিজেরা তৈরি করতে পারে। পরবর্তিতে আদি পরভোজী ইউক্যারিওটিক কোষ ঐ প্রোক্যারিওটিক কোষকে আবৃত করে। আদি প্রোক্যারিটিক কোষ অক্সিজেন মুক্ত পরিবেশে বাস করত অর্থাৎ অক্সিজেনের আধিক্য হলে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হত। ধাপে ধাপে এদের কোষ প্রাচীর দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যাওয়ায় একটি আদি ইউক্যারিওটিক কোষ তার কোষপ্রাচীরকে আবৃত করে।

 

দেখা যাচ্ছে প্রোক্যারিওটিক ব্যাকটেরিয়া খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে কিন্তু ইউক্যারিওটিক কোষটি খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে না। অপরদিকে প্রোক্যারিওটিক কোষ অক্সিজেন সহনীয় নয় কিন্তু ইউক্যারিওটকি কোষটি অক্সিজেন ব্যবহার করে। ফলে তাদের মধ্যে মিথোজীবিতা সৃষ্টি হয় এবং তারা এক সাথে অবস্থান করে। জৈব অভিব্যক্তির ধারায় বর্তমানে ইউক্যারিওটিক কোষ এই দুইটি বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। ফলশ্রুতিতে তাদের পারস্পারিক ক্রিয়ায় সৃষ্ট অঙ্গাণু ক্লোরোপ্লাস্ট (খাদ্য প্রস্তুত করা) ও মাইটোকন্ড্রিয়াকে (অক্সিজেন ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন) একইসাথে একটি কোষে (উদ্ভিদকোষ) আমরা দেখতে পায়। চিত্র ৫.১-এ এন্ডোসিমবায়োসিস প্রক্রিয়ায় মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।  

 

চিত্র ৫.১: এন্ডোসিমবায়োসিস প্রক্রিয়া   

চিত্রে নির্দেশিত প্রতিটি ধাপে বুঝানো হয়েছে, প্রাথমিক দিকের ইউক্যারিওটিক কোষ অন্যান্য প্রোক্যারিওটিক কোষকে আবৃত করতে পারে। ইউক্যারিওটিক কোষ আলফা প্রোটোব্যাকটেরিয়াম নামক এক প্রকার প্রোক্যারিওটিক কোষকে ঝিল্লি দিয়ে আবৃত করে। প্রোক্যারিওটিক কোষটি অক্সিজেন ব্যবহার করে শক্তি উৎপন্ন করত। পরবর্তীতে এই ইউক্যারিওটিক কোষটি প্রোক্যারিওটিক কোষের সাথে মিথোজীবী সম্পর্ক সৃষ্টি করে। ফলে ইউক্যারিওটিক কোষ প্রোক্যারিওটিক কোষকে নিরাপত্তা ও পুষ্টি প্রদান করে, বিনিময়ে ইউক্যারিওটিক কোষটি প্রোক্যারিওটিক কোষের শ্বসনিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন অতিরিক্ত শক্তি লাভ করে। সময়ের ব্যবধানে সিমবায়োন্ট (প্রোক্যারিওটিক কোষ) কোষটি কিছু জিন হারায়। ফলে এটি পোষক কোষ তথা ইউক্যারিওটিক কোষে স্থায়ীভাবে বাস করে। প্রোক্যারিওটিক কোষের কিছু জিন পোষক ইউকারিওটিক কোষের নিউক্লিয়াসে পরিবাহিত হয়। এর মাধ্যমে প্রোক্যারিওটিক কোষ ইউক্যারিওটিক কোষ থেকে জৈব অণু ও অজৈব যৌগ গ্রহণ করে।

প্রোক্যারিওটিক কোষের শ্বসন প্রক্রিয়া নির্দেশক জিন পরবর্তিতে মাইটোকন্ড্রিয়াতে রূপান্তরিত হয়। ফলে মাইটোকন্ড্রিয়া যুক্ত ইউক্যারিওটিক কোষের উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে দেখা গেল উৎপন্ন এই কোষের কোনো একটি এক প্রকার প্রোক্যারিওটিক কোষকে আবৃত করছে যা খাদ্য উৎপাদন করতে পারে। ফলে একটি ইউক্যারিওটিক কোষের মধ্যে নতুন একটি প্রোক্যারিওটিক কোষ মিথোজীবীতা প্রদর্শন করে এবং সময়ের ধারায় এটি স্থায়ীভাবে ইউক্যারিওটিক কোষে অবস্থান করে। ফলে জৈব অভিব্যক্তির ধারায় আমরা ইউক্যারিওটিক উদ্ভিদ কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট দেখতে পাই। বিজ্ঞানীমহলে এই তত্ত্ব স্বীকৃত। প্রশ্ন হলো মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যে কি এমন কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে এন্ডোসিমবায়োন্ট তত্ত্ব সত্য?

উত্তর হবে ‘হ্যাঁ। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা এই দুইটি অঙ্গাণুর গঠন বিশ্লেষণ করতে পারি। ইতোমধ্যে আমরা জানেছি এন্ডোমেমব্রেন সিস্টেমের আওতাভুক্ত এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, গলজি বস্তু, কোষ গহ্বর একটি মাত্র পর্দা দিয়ে আবৃত। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট দ্বিস্তরবিশিষ্ট পর্দা দিয়ে আবৃত। এই তথ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় যেসব কোষ থেকে এদের আবির্ভাব তা দ্বিস্তরবিশিষ্ট মেমব্রেন দিয়ে আবৃত ছিল যা পরবর্তিতে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের মেমব্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রোক্যারিওটিক কোষের মত মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টে রাইবোসোম ও বৃত্তাকার ডিএনএ বিদ্যমান। মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টের অন্তঃমেমব্রেনে রাইবোসোম ও ডিএনএ যুক্ত থাকে। ডিএনএ অঙ্গাণু দুইটির প্রয়োজনীয় কিছু প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়, যা রাইবোসোমে উৎপন্ন হয়। জৈব অভিব্যক্তির ধারায় কোষের অঙ্গাণু হিসেবে বিবেচিত হলেও মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট অটোনোমাস অঙ্গাণু।

মাইটোকন্ড্রিয়া: কোষের শক্তি ঘর

মোটামুটিভাবে প্রায় সব কোষেই মাইটোকন্ড্রিয়া আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিদ, প্রাণি, ছত্রাক এবং অধিকাংশ প্রোটিস্টের কোষে মাইটোকন্ড্রিয়া আছে। তবে কোষভেদে এদের সংখ্যা ভিন্ন। অল্পকিছু সংখ্যক কোষে বৃহৎ আকারের একটিমাত্র মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। তবে অধিকাংশ কোষে কয়েকশত থেকে কয়েক হাজার মাইটোকন্ড্রিয়া বিদ্যমান। মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা কোষের জৈবিক কার্যাবলীর ওপর নির্ভর করে। স্বাভাবিকভাবে যে সকল কোষে জৈবিক কার্যাবলীর মাত্রা অধিক তাতে অধিক শক্তি প্রয়োজন। আর কোষে শক্তি সরবরাহের কাজ করে মাইটোকন্ড্রিয়া। ফলে এসব কোষে অনেক বেশি সংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে।

প্রতিটি মাইটোকন্ড্রিয়া দ্বিস্তরবিশিষ্ট পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। ফসফোলিপিড আবরণের দুইটি স্তরের মাঝে প্রোটিন নিমজ্জিত থাকে। বাইরের কোষপ্রাচীর মসৃণ, তবে ভিতরের প্রাচীর ভাঁজ হয়ে আঙ্গুলের মত আকার গঠন করে, যা ক্রিস্টি (Cristae) নামে পরিচিত। দেখে মনে হবে যেন কতগুলো মোটা মোটা আঙ্গুল পাশাপাশি যুক্ত। ভেতরের পর্দা ভাঁজ হয়ে মাইটোকন্ড্রিয়নের ভেতরে দুইটি অঞ্চল সৃষ্টি করেছে। এর একটি হলো বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ ঝিল্লির মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা বা আন্তঃঝিল্লিয় ফাঁক। অপরটি হলো মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্স (Matrix), যা ঝিল্লি দিয়ে আবৃত থাকে। ম্যাট্রিক্সে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উপাদান থাকে। এর মধ্যে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ও রাইবোসোম অন্যতম। এছাড়াও ম্যাট্রিক্সে বিভিন্ন প্রকার এনজাইম থাকে। এসব এনজাইম শ্বসন প্রক্রিয়ায় সংঘটিত বিভিন্ন বিক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করে।  মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তঃস্থ ঝিল্লিতে শ্বসনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রোটিন, এটিপি উৎপন্নের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম উৎপন্ন হয়। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি যে, মাইটোকন্ড্রিয়া জৈব অভিব্যক্তির ধারায় তার পূর্বপুরুষ থেকে রাইবোসোম ও ডিএনএ লাভ করেছে। এর ফলে এটি নিজেই প্রয়োজনীয় প্রোটিনতৈরি করতে পারে। মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তঃস্থ পর্দা ভাঁজ হয়ে যে ক্রিস্টি হয় তার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর ফলে মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তঃস্থ পর্দার পৃষ্ঠতল বৃদ্ধি পায়। ফলে কোষের শ্বসন প্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধি পায়। সাধারণত প্রতিটি মাইটোকন্ড্রিয়া ১-১০ মাইক্রোমিটার লম্বা হয়ে থাকে। আমরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে মাইটোকন্ড্রিয়ার একটি স্থির চিত্র দেখি যা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখ করা হয়। মূলত মাইটোকন্ড্রিয়া স্থির নয়। আমরা যে চিত্র দেখি তা মৃত কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া। তবে বিজ্ঞানীরা জীবিত কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ার ভিন্ন চিত্র দেখতে পেয়েছেন। দেখা গেছে জীবিত কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া গতিশীল, একটি মাইটোকন্ড্রিয়া ভেঙে দুইটি মাইটোকন্ড্রিয়া, অপরদিকে একাধিক মাইটোকন্ড্রিয়া উৎপন্ন হচ্ছে। আধুনিক গবেষণা এটি স্পষ্ট হয়েছে যে মাইটোকন্ড্রিয়া সবসময় তাদের আকার পরিবর্তন করে। চিত্র ৫.২-এ একটি মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন দেখানো হয়েছে। 


চিত্র ৫.২: মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন

  ৫.২ (a) নং চিত্রে মাইটোকন্ড্রিয়ার অন্তঃস্থ ও বহিঃস্থ পর্দা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্তঃস্থ পর্দা ফাঁক হয়ে ক্রিস্টি গঠন করেছে যা মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরিন পৃষ্ঠের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। মাঝের চিত্রে স্পষ্টভাবে অন্তঃস্থ ও বহিঃস্থ পর্দার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি মুক্ত রাইবোসোম, ডিএনএ, ক্রিস্টি ও ম্যাট্রিক্স দেখানো হয়েছে।  ৫.২ (b)  চিত্রে এককোষী প্রোটিস্টের মাইটোকন্ড্রিয়া দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়া শাখাযুক্ত নলাকার আকার লাভ করেছে। পাশাপাশি প্রোটিস্টার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ ও নিউক্লিয়ার ডিএনএ দেখা যাচ্ছে।
 

ক্লোরোপ্লাস্ট: আলোক শক্তি শোষণ ও রূপান্তর

উদ্ভিদকোষে থাকা ক্লোরোপ্লাস্ট সৌরশক্তি শোষণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা উৎপাদন করে। ক্লোরোপ্লাস্টে সবুজ রঙের পিগমেন্ট থাকে। এছাড়াও ক্লোরোপ্লাস্টে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় এনজাইম ও অন্যান্য যৌগ থাকে। ক্লোরোপ্লাস্ট দেখতে অনেকটা লেন্সের মত এবং ৩-৬ মাইক্রোমিটার লম্বা হয়। উদ্ভিদদেহের পাতা ও অন্যান্য সবুজ অঙ্গে ক্লোরোপ্লাস্টের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি ক্লোরোপ্লাস্ট দ্বিস্তর বিশিষ্ট মেমব্রেন দিয়ে আবৃত। এই মেমব্রেন সাইটোসলের অন্যান্য অঙ্গাণু থেকে ক্লোরোপ্লাস্টকে আলাদা করে রাখে। দ্বিস্তরবিশিষ্ট মেমব্রেনের বহিস্থ ও অন্তস্থ মেমব্রেনের মাঝে সামান্য ফাঁকা জায়গা থাকে। ক্লোরোপ্লাস্টের অভ্যন্তরে চ্যাপ্টাকৃতির মেমব্রেনের মতো অঙ্গাণু থাকে যা থাইলাকয়েড (Thylakoids) নামে পরিচিত। থাইলাকয়েড হলো পরস্পরের সাথে যুক্ত থলি। অনেকসময় থাইলাকয়েডগুলো একটির পর আরেকটি সজ্জিত থাকে যাদেরকে গ্রানাম (বহুবচনে গ্রানা) বলে। থাইলাকয়েডের বাইরে অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট অন্তঃস্থ ঝিল্লি দিয়ে আবৃত পানিগ্রাহী অংশকে স্ট্রোমা বলে। স্ট্রোমায় ক্লোরোপ্লাস্ট ডিএনএ এবং রাইবোসোম ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার এনজাইম থাকে। ক্লোরোপ্লাস্টের মেমব্রেন ক্লোরোপ্লাস্টকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছে: আন্তঝিল্লিয় ফাঁক যা বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ ঝিল্লির মধ্যবর্তী জায়গায় অবস্থিত, স্ট্রোমা অর্থাৎ আবরণী ঝিল্লি দিয়ে আবৃত পানিগ্রাহী স্থান এবং থাইলাকয়েড অংশ। ক্লোরোপ্লাস্টের এমন তিনটি অংশের পারস্পারিক সমন্বয়ের ফলে ক্লোরোপ্লাস্ট আলোক শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। চিত্র ৫.৩-এ ক্লোরোপ্লাস্টের গঠন দেখানো হয়েছে।


চিত্র ৫.৩: ক্লোরোপ্লাস্টের গঠন

সচরাচর আমরা পাঠ্যপুস্তকে ক্লোরোপ্লাস্টের যে চিত্র দেখি তা সজীব জীবের ক্লোরোপ্লাস্টের চিত্র প্রকাশ করে না। জীবিত কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট স্থির নয়, প্রতিনিয়ত এর আকার পরিবর্তিত হয়। এছাড়াও একটি ক্লোরোপ্লাস্ট নতুন দুইটি ক্লোরোপ্লাস্ট উৎপন্ন হয়। মাইটোকন্ড্রিয়া ও অন্যান্য অঙ্গাণুর সাথে ক্লোরোপ্লাস্ট প্রোটোপ্লাজমে পরিভ্রমণ করে। ক্লোরোপ্লাস্ট হলো উদ্ভিদ দেহে বিদ্যমান প্লাস্টিড অঙ্গাণুর একটি অংশ। সাধারণত উদ্ভিদের সবুজ অংশে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে। উদ্ভিদকোষে ক্লোরোপ্লাস্ট ছাড়াও অ্যামাইলোপ্লাস্ট ও ক্রোমোপ্লাস্ট নামক প্লাস্টিড থাকে। অ্যামাইলোপ্লাস্ট হলো এক প্রকার বর্ণহীন অঙ্গাণু, যা শর্করা সঞ্চয় করে। অপরদিকে ক্রোমোপ্লাস্ট বিভিন্ন প্রকার পিগমেন্ট ধারণ করে উদ্ভিদের রঙিন বর্ণ (যেমন: ফুল ও  ফলের কমলা ও হলুদ বর্ণ) প্রদান করে। 

পারঅক্সিসোম: অক্সিডেশন

কোষে একস্তরবিশিষ্ট ঝিল্লি দিয়ে আবৃত অংশ থাকে  যা পারঅক্সিসোম নামে পরিচিত। গাঠনিক দিক দিয়ে লাইসোসোমের সাথে পারঅক্সিসোমের মিল আছে। পারঅক্সিসোমে বিশেষ ধরনের এনজাইম আছে, যা কোনো যৌগ থেকে হাইড্রোজেন পরমাণুকে বিমুক্ত করতে পারে এবং অক্সিজেন পরমাণু যোগ করে। ফলে বাই প্রডাক্ট হিসেবে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H2O2) উৎপন্ন হয়।  

পারঅক্সিসোমের এনজাইম দিয়ে সংঘটিত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের বিক্রিয়াটি খুব সাধারণ মনে হলেও জীবদেহে এর গুরুত্ব অধিক। কিছু পারঅক্সিসোম জৈব এসিডকে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যৌগে পরিণত করতে অক্সিজেন ব্যবহার করে। এসব ক্ষুদ্র যৌগ পরবর্তীতে মাইটোকন্ড্রিয়ায় শ্বসনিক বিক্রিয়ার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যকৃতের পারঅক্সিসোম অ্যালকোহল ও অন্যান্য ক্ষতিকর যৌগের ক্রিয়া বিনষ্ট করে। এক্ষেত্রে পারঅক্সিসোম অ্যালকোহল বা ক্ষতিকর যৌগের হাইড্রোজেন বিমুক্ত করে অক্সিজেন যোগ করে। ফলে এসব পদার্থের ক্রিয়া বিনষ্ট হয়।  

পারঅক্সিসোম যে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড (H2O2) উৎপন্ন করে তা খুবই বিষাক্ত। তবে কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণুতে এমন কিছু এনজাইম থাকে যা বিষাক্ত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ভেঙে পানি উৎপন্ন করতে পারে। কোষের অঙ্গানু ও এর বিভিন্ন উপাদান কোষ স্বাভাবিক রাখার জন্য কতটা জরুরী তা এই উদাহরণের মাধ্যমে বুঝা যায়। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদনকারী এনজাইম এবং ক্ষতিকর পদার্থ বিনষ্টকারী এনজাইম থেকে অন্যান্য অঙ্গাণুগুলো দুরে অবস্থান করে যেন এনজাইমের প্রভাবে এসব অঙ্গাণুর কোনো ক্ষতি না হয়। চিত্র ৫.৪-এ পার অক্সিসোমের গঠন দেখানো হলো। পারঅক্সিসোমে গোলাকার ও দানাকৃতির বা স্বচ্ছ আকৃতির কোর (core) থাকে। ধারণা করা হয় এসব কোরে এনজাইম থাকে। বিভিন্ন বিপাক ক্রিয়ায় পারঅক্সিসোমের সাথে মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট ক্রিয়া করে।

 

 

চিত্র ৫.৪: পারঅক্সিসোমের গঠন

জীবদেহের পারঅক্সিসোম বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। উদ্ভিদের বীজে গ্লাইকোসোম নামক বিশেষ ধরনের পারঅক্সিসোম থাকে যা চর্বি সঞ্চয় করে। গ্লাইকোসোমে এক প্রকার এনজাইম থাকে যা চর্বি ভেঙে শর্করা উৎপন্ন করে। বীজ অঙ্কুরোদগমের পর থেকে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় নিজে খাদ্য উৎপাদন করার সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে এই শর্করা থেকে শিশু চারাকে প্রয়োজনীয় শক্তি ও কার্বন যোগান দেওয়া হয়।

উদ্ভিদ ক্লোরোপ্লাস্টের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে। কোনো বীজের অঙ্কুরোদগম হওয়া মাত্রই কিন্তু এটি খাদ্য তৈরি করতে পারে না। একটি নির্দিষ্ট ধাপ অতিক্রম করার পর যখন সুগঠিত পাতা উৎপন্ন হয়, তখনই কেবল খাদ্য তৈরি করতে পারে। আর অঙ্কুরোদগম হওয়া থেকে নিজে খাদ্য তৈরির সক্ষমতা তৈরির আগ পর্যন্ত উদ্ভিদ (চারা গাছ) গ্লাইঅক্সিসোমের মাধ্যমে উৎপন্ন শর্করা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। অন্যান্য অঙ্গাণুর সাথে পারঅক্সিসোমের সম্পর্ক কি?

বিজ্ঞানীমহলে এটি একটি বহুল আলোচিত প্রশ্ন। কিভাবে এদের বৃদ্ধি ঘটে? সাইটোসল এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে উৎপন্ন প্রোটিন বা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে উৎপন্ন হওয়া লিপিড বা নিজেদের সাথে যুক্ত হয়ে পারঅক্সিসোমের বৃদ্ধি ঘটে। নির্দিষ্ট আকার লাভ করার পর একটি পারঅক্সিসোম ভেঙে দুইটি পারঅক্সিসোমে পরিণত হয়। উৎপন্ন পারঅক্সিসোম মাতৃ পারঅক্সিসোমের মত স্বাভাবিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। পারঅক্সিসোমের এভাবে ভেঙ্গে উৎপত্তির কারণ হিসেবে একদল বিজ্ঞানী এন্ডোসিমবায়োন্ট তত্ত্বকে উল্লেখ করেছেন। তবে অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন এন্ডোসিমবায়োন্ট পদ্ধতিতে পারঅক্সিসোম উৎপন্ন হয় না। তবে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোনো তত্ত্বে একমত হতে পারেন নি। এই বিতর্ক এখন পর্যন্ত চলমান।

ক্লোরোপ্লাস্ট ও মাইটোকন্ড্রিয়া সম্পর্কে কী জানলে? নিজেকে যাচাই করতে নিজের দক্ষতা লেভেল জানার জন্য মনযোগ দিয়ে পড় ও মডেল টেস্ট দাও। পরবর্তীতে মডেল টেস্ট নেওয়া হবে।

সূত্র: Campbell Biology (মূল ক্যাম্পবেল বায়োলজির কোষ ইউনিট নিয়ে বাংলায় “ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) প্রকাশ করেছে ল্যাববাংলা প্রকাশনী)

জীববিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানতে ও জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হতে ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট) ও ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) বই দুইটি পড়তে পারো।

 

 

 

 



Blogger দ্বারা পরিচালিত.