-->

কোষবিদ্যা-০৪: কোষদেহের এন্ডোমেমব্রেন সিস্টেম

 ইউক্যারিওটিক কোষে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার মেমব্রেন এন্ডোমেমব্রেন সিস্টেমের অংশ। যেমন: নিউক্লিয়ার পর্দা, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম, গলজি বস্তু, লাইসোসোম, গহ্বর ও বিভিন্ন প্রকার ভেসিকল। অন্যান্য অঙ্গাণুর তুলনায় এদের গঠন সরল হলেও এদের গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। এরা কোষে উপস্থিত থেকে প্রোটিন সংশ্লেষণ, বিভিন্ন অঙ্গাণু ও ঝিল্লিতে প্রোটিন প্রবেশ ও বহির্গমন, লিপিডের বিপাক ক্রিয়া ও চলন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণুর ক্রিয়ানাশ ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করে থাকে। এসব মেমব্রেন পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কখনো বাহ্যিকভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। আবার কখনো রূপান্তরিত হয়ে ফোসকা আকৃতির থলের মতো বস্তু বা ভেসিকল গঠন করে। নিজেদের মধ্যে বিস্তর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও গঠন ও কাজের দিক দিয়ে এদের মধ্যে কোনো মিল নেই। কোনো একটি নির্দিষ্ট মেমব্রেনের পুরো জীবনকালে এর পুরুত্ব, আণবিক গঠন ও এর অভ্যন্তরে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া নির্দিষ্ট নয়। কারণ মেমব্রেনের পুরো জীবনকালে এসব ক্রিয়া বহুবার পরিবর্তিত হয়।

এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম: জৈব সংশ্লেষণের কারখানা

কোনো একটি ইউক্যারিওটিক কোষে যে পরিমাণ মেমব্রেন থাকে, তার অধিকাংশই এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম। ১৯৪৫ সালে বিজ্ঞানী কেইথ আর, পোর্টার ও তার সহকর্মীরা সর্বপ্রথম ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম পর্যবেক্ষণ করেন। এটি এমন একটি অঙ্গাণু, যা অধিকাংশ প্রাণিকোষ ও উদ্ভিদকোষে দেখা যায়। তবে লোহিত রক্ত কণিকার (রক্তের এক প্রকার কণিকা) কোষে এন্ডাপ্লাজমিক রেটিকুলাম থাকে না। 

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাণিকোষের মোট মেমব্রেনের শতকার ৫০ ভাগই এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম। এন্ডোপ্লাজমিক (endoplasmic) অর্থ সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে এবং রেটিকুলাম (reticulum) অর্থ ক্ষুদ্র জালিকা। তাই বলা যায়, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম হলো সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে বিস্তৃত ক্ষুদ্র জালিকা। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তর ভাগকে বলা হয় এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম লুমেন। এর লুমেন অংশ ঝিল্লি দিয়ে সাইটোপ্লাজম থেকে পৃথক থাকে। কোষের মধ্যে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম সবসময় নিউক্লিয়াসের সাথে অবস্থান করে। লক্ষ্য করলে দেখবে নিউক্লিয়ার ঝিল্লির কোনো এক অংশ প্রবর্ধিত হয়ে জালিকাকার বা সিলিন্ডার আৃকতির গঠন লাভ করেছে। এই সিলিন্ডার আৃকতির গঠন পরস্পরের সাথে সমান্তরালে সাইটোপ্লাজমের দিকে অগ্রসর হয়। চিত্র ৪.১-এ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গঠন দেখানো হয়েছে।

চিত্র ৪.১: এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গঠন

সিলিন্ডার আকৃতির এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামকে বলে সিস্টারনি, যা পরস্পরের সাথে সমান্তরালে অবস্থান করে। এগুলো লম্বা, শাখাবিহীন, চ্যাপ্টা থলের মতো। এছাড়াও সাইটোপ্লাজমে গোল বা ডিম্বাকার থলের মতো ও শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামও থাকে। সাধারণত সাইটোপ্লাজমে দুই ধরনের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম দেখা যায়। এর একটি মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (Smooth ER), অপরটি অমসৃণ এন্ডাপ্লাজমিক রেটিকুলাম (Rough ER)| যেসব এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গায়ে রাইবোসোম দানা থাকে তাকে অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম বলে। অপরদিকে মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গাত্রে কোনো রাইবোসোম দানা থাকে না। কোষে উভয় ধরনের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থাকে। তারা উভয়ই কোষে গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। গবেষণায় দেখা যায় যেসব কোষে অধিক অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম বিদ্যমান তারা অধিক হারে প্রোটিন উৎপাদন করে। অপরদিকে কোষে মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের কারণে লিপিড ও স্টেরওয়েড হরমোন তৈরী হয়।

মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের কাজ

কোষে মসৃণ এন্ডাপ্লাজমিক রেটিকুলাম বহুবিধ কাজ করে থাকে। তবে কোষভেদে এর কাজের পার্থক্য দেখা যায়। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম কোষে যেসব কাজ সম্পাদন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো:

১) লিপিড সংশ্লেষণ: মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে থাকা বিভিন্ন এনজাইম লিপিড জাতীয় পদার্থের সংশ্লেষণ ঘটায়। বিশেষ করে তেল, ফসফোলিপিড এবং স্টেরয়েড সংশ্লেষণে এসব এনজাইম সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রাণিদেহে উৎপন্ন হওয়া স্টেরওয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ লিপিড। মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে উৎপন্ন হওয়া বিশেষ ধরনের স্টেরওয়েড প্রাণিকোষের লিঙ্গ নির্ধারক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও মূত্রথলির গ্রন্থি বিভিন্ন প্রকার স্টেরওয়েড নিঃসৃত করে। যেসব কোষ এসব এনজাইম নিঃসৃত করে তারা অধিক সংখ্যক মসৃণ এন্ডাপ্লাজমিক রেটিকুলাম ধারণ করে।

২) ড্রাগ ও ক্ষতিকর জীবাণুর ক্রিয়া: এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম বিশেষ ধরনের এনজাইম উৎপন্ন করে। এরা বিভিন্ন প্রকার ড্রাগ ও জীবাণুর ক্রিয়া বিনষ্ট করে। বর্তমান সময়ে ড্রাগের প্রতি আসক্তি ভয়ানক রূপ লাভ করেছে। মূলত সব ড্রাগ অ্যালকোহলিক উপাদান বহন করে। এসব ড্রাগ গ্রহণ করলে আমাদের ¯œায়ুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়। তবে আমাদের দেহের যকৃতে অবস্থানকারী মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের একটি অংশ এসব ড্রাগ ও ক্ষতিকর অ্যালকোহলের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। তবে আমাদের শরীরে অ্যালকোহলের একটি নির্দিষ্ট সহনীয় মাত্রা আছে।  মাত্রা অতিক্রম করলেই তা আমাদের শরীরে ক্ষতিকর রূপ ধারণ করে। মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ক্ষতিকর মাত্রার ড্রাগের ক্রিয়া বিনষ্ট করতে পারে। 

৩) ক্যালসিয়াম সঞ্চয়: মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ক্যালসিয়াম সঞ্চয় করে। জীবদেহের জন্য যেসব মৌল উপাদান দরকার তার মধ্যে অন্যতম ক্যালসিয়াম। প্রতিনিয়ত আমরা ক্যালসিয়ামের উপকারিতার কথা শুনে থাকি। আমাদের অস্থি মজবুত করতে এর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। মাংসপেশীর এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম সাইটোসলের ক্যালসিয়ামকে পাম্প করে, ফলে ক্যালসিয়াম লুমেনে (এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তরীণ গহ্বর) জমা হয়। অপরদিকে মাংসপেশীর সংকোচনে লুমেন থেকে ক্যালসিয়াম সাইটোসলে ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে এটা স্পষ্ট যে, কোষে ক্যালসিয়াম সঞ্চয় ও প্রয়োজনে ক্যালসিয়াম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে মসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের কাজ

৪) অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গায়ের সাথে রাইবোসোম দানা যুক্ত থাকে। আর ডিএনএ কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাইবোসোমে বিভিন্ন প্রকার প্রোটিন তৈরি হয়। এই প্রোটিনই জীবদেহের বিভিন্ন আকার গঠন করে। এখান থেকে এটা স্পষ্ট যে, অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম প্রোটিন তৈরি করতে পারে। প্রোটিন হলো অ্যামাইনো এসিডের বিশাল যৌগ। অর্থাৎ পাশাপাশি দুইটি অ্যামাইনো এসিড পরস্পরের সাথে পেপটাইড বন্ধন দিয়ে যুক্ত থাকে। অনেকটা তোমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় পাশাপাশি দাড়ানো বন্ধুদের হাত ধরে থাকার মতো। যখন অসংখ্য অ্যামাইনো এসিড পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে তখন তাদের মধ্যে অসংখ্য পেপটাইড বন্ধন থাকে। অসংখ্য পেপটাইড বন্ধনকে জৈবরসায়নের ভাষায় পলিপেপটাইড বলে (পলিপেপটাইড হলো অসংখ্য অ্যামাইনো এসিডকে পেপটাইড বন্ধন দিয়ে যুক্ত করা)। তাই এককথায় বলা যায়, প্রোটিন হলো অসংখ্য পেপটাইড দিয়ে যুক্ত অ্যামাইনো এসিড।

৫) অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গাত্রে যুক্ত রাইবোসোম বিভিন্ন প্রকার প্রোটিন সংশ্লেষ করে। এসব প্রোটিন ভিন্ন ভিন্ন রূপে কোষদেহে ব্যবহৃত হয়। এটা মনে রাখতে হবে যে প্রোটিন তৈরির একমাত্র কারখানা রাইবোসোম। যেহেতু অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লিতে রাইবোসোম থাকে, তাই এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লিতে প্রোটিন উৎপন্ন হবে। পরবর্তীতে উৎপন্ন প্রোটিন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তরে তথা লুমেনে প্রবেশ করে। অগ্ন্যাশয় কোষের অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপন্ন হয়, যা এক প্রকার প্রোটিন। উৎপন্ন ইনসুলিন অগ্ন্যাশয় থেকে রক্তের মাধ্যমে দেহে প্রবাহিত হয়।

৬) কিছু কিছু প্রোটিন উৎপন্ন হওয়ার পর লুমেনে প্রবেশ করে। আর কিছু প্রোটিন অন্য অবস্থায় রূপান্তরের জন্য এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লিতে অবস্থান করে। রূপান্তরিত প্রোটিন বিশেষ প্রক্রিয়ায় লুমেনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে, প্রথমে প্রোটিনের পলিপেপটাইড বন্ধন সূতার মতো আকৃতি ধারণ করে। এরপর ছিদ্রের মধ্য দিয়ে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তরে তথা লুমেনে প্রবেশ করে। লুমেন তথা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তরে পলিপেপটাইড শিকলের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে আমরা প্রোটিনকে বিভিন্ন রূপে দেখতে পাই। এটি মনে রাখতে হবে যেসব প্রোটিনের প্রাথমিক রূপ হলো পলিপেপটাইড শিকল, যা লুমেনে ভাঁজ হতে হতে এটি বিভিন্ন রূপ লাভ করে। যেমন: লোহিত রক্ত কণিকায় বিদ্যমান হিমোগ্লোবিন। এটি এক প্রকার প্রোটিন। লুমেনে পলিপেপটাইড শিকল ভাঁজ হয়ে হয়ে এমন আকার ধারণ করে। লুমেনের মধ্যে প্রোটিন কিভাবে ভাঁজ হয়ে বিভিন্ন আকার ধারণ করে তার ক্যাম্পবেল বায়োলজি (জৈব রসায়ন ইউনিট) বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রোটিনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক গ্রুপ (অ্যামাইড গ্রুপ, গ্লুকোজ গ্রুপ প্রভৃতি) প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন উচ্চ আণবিক ভর বিশিষ্ট প্রোটিন উৎপন্ন করে। ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক গ্রুপযুক্ত প্রোটিন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন: প্রোটিনের সাথে কার্বোহাইড্রেট গ্রুপ যুক্ত থাকলে তাকে গ্লাইকোপ্রোটিন বলে। মূলত লুমেনে উৎপন্ন হওয়া প্রোটিনের সাথে কার্বোহাইড্রেট এনজাইম দিয়ে যুক্ত থাকে। প্রোটিন তৈরির পাশাপাশি এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লি সাইটোসলের মুক্ত প্রোটিন থেকে নিজেদের লুমেনের ভিতরে থাকা প্রোটিনকে আলাদা করে রাখে। কারণ কোষের সাইটোপ্লাজমে মুক্ত রাইবোসোম বিদ্যমান। মুক্ত রাইবোসোমে যেসব প্রোটিন উৎপন্ন হয় তাদের প্রকৃতি এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের রাইবোসোমে উৎপন্ন হওয়া প্রোটিন থেকে আলাদা। অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে ঝিল্লি এই দুই ধরনের প্রোটিনকে আলাদা করে। আমরা জানি এনজাইম ও হরমোন প্রভৃতি নিঃসৃত পদার্থ এক প্রকার প্রোটিন। অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে এসব প্রোটিন সাইটোসলে নিঃসৃত হয়।

৭) অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম কোষের মেমব্রেন তৈরির কারখানা হিসেবে পরিচিত। এটি কোষের মেমব্রেন, গলজি বস্তু, কোষ গহবর, লাইসোসোম, এন্ডোসোম এমনকি নিজের আবরণের জন্য প্রয়োজনীয় মেমব্রেন তৈরি করে।

গলজি বস্তু

এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে প্রোটিন উৎপন্ন হয়ে গলজি বস্তুতে প্রবেশ করে। এটি ঝিল্লি দিয়ে গঠিত অঙ্গাণু, যা সাধারণত অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গায়ের সাথে অবস্থান করে। সাধারণত প্রোটিন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের লুমেনে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়। কোনো প্রোটিনের পেপটাইড বন্ধনে ত্রুটি আছে কি না, পর্যাপ্ত অ্যামাইনো এসিডের সংযোগ হয়েছে কি না প্রভৃতি লুমেনে যাচাই বাছাই শেষে প্রোটিনের সংশ্লেষণ ঘটে। এরপর চূড়ান্ত যাচাই বাছাইয়ের জন্য প্রোটিন গলজি বস্তুতে পরিবাহিত হয়। এটি অনেকটা কারখানায় কোনো পণ্য উৎপাদনের মতো। নিশ্চয় তোমরা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে কোক, পটেটো ক্র্যাকারস, পানীয় প্রভৃতি পণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখেছ। এসব কারখানায় পুরো প্রক্রিয়া শেষে একটি ইউনিট থাকে যা ‘ফিনিশিং ইউনিট’ নামে পরিচিত। এখান থেকে কোনো পণ্য বাজারজাত করার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কোষে অবস্থানকারী গলজি বস্তু প্রোটিনের ক্ষেত্রে ‘ফিনিশিং ইউনিট’ হিসেবে কাজ করে। প্রোটিন গলজি বস্তুতে প্রোসেসিংয়ের পর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে। ইউক্যারিওটিক কোষের সাইটোপ্লাজমে অবস্থানকারী (বিশেষ করে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের সন্নিকটে) গলজি বস্তু প্রোটিন সরবরাহ, এর আকার রূপান্তর ও প্যাকেজিং করে থাকে। মূলত অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে আগত প্রোটিনকে চূড়ান্ত প্রক্রিয়াজাত শেষে এটি ভেসিকলে (গলজি বস্তুর গায়ে লেগে থাকা ফোসকার মতো উপাদান) জমা রাখে। এরপর ভেসিকল থেকে প্রোটিন কাজ ভেদে নির্দিষ্ট অঙ্গাণু বা অঞ্চলে গমন করে। অধিকাংশ কোষে একটি বা একাধিক গলজি বস্তু থাকে। তবে উদ্ভিদকোষে এর সংখ্যা শতাধিক। গলজি বস্তু মূলত এক স্তর বিশিষ্ট ঝিল্লি দিয়ে গঠিত। বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হবে অসংখ্য নানরুটি একসাথে জড়ো হয়ে আছে। তবে নানরুটির মত হলেও এর অভ্যন্তর ভাগ ফাঁপা। এর আকৃতি বুঝতে আমাদের এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গঠন বুঝতে হবে। এরা অনেকটা একই রকম। আমরা যে রুটির উদাহরণ দিলাম এটি মূলত লেন্স আকৃতির ঝিল্লি পরস্পরের সাথে যুক্ত। এটিকে বলা হয় সিস্টার্নি (cisternae)। আর ঝিল্লি দিয়ে আবৃত ভেতরের গহবর লুমেন (Lumen)   

আমরা এ বিষয় জানি যে, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে উৎপন্ন প্রোটিন গলজি বস্তুতে এসে পরিবর্তিত  হয়ে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে আগত ভেসিকল (প্রোটিন ধারণকারী ফোসকার মত অঙ্গাণু) গলজি বস্তুর ঝিল্লির সাথে মিলিত হয় এবং গলজি বস্তুকে প্রোটিন সরবরাহ করে। প্রোটিন গলজি বস্তুর মেমব্রেন ভেদ করে এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এখন দেখা যাক কিভাবে প্রোটিন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে গলজি বস্তু এবং গলজি বস্তু থেকে অন্যান্য অঙ্গাণুতে প্রবাহিত হয়। অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লিতে থাকা রাইবোসোমে উৎপন্ন প্রোটিন বিশেষ ছিদ্রের মাধ্যমে লুমেনে (এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের অভ্যন্তর ভাগ) প্রবেশ করে। এর অভ্যন্তরে পরিবর্তন,পরিবর্ধন শেষে প্রোটিন লুমেনে অবস্থান করে। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের যে অংশে গলজি বস্তু যুক্ত থাকে সেই দিকে বিশেষ একটি ঘটনা ঘটে। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের লেন্সের মত সিস্টের প্রান্তভাগের অভ্যন্তরের লুমেন ফোসকার মত আলাদা হয়ে যায় এবং সামনের দিকে ধাবিত হয়। অতপর তা গলজি বস্তুর মেমব্রেনের সাথে যুক্ত হয়। গলজি বস্তুর মেমব্রেন ও এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে ভেসিকলের মেমব্রেনের সংযোগস্থল মিলিত হয়ে প্রোটিন গলজি বস্তুর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরপর গলজি বস্তুর মধ্যে এর বিভিন্ন পরিবর্তন শেষে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটে। গলজি বস্তুর একদিক দিয়ে প্রোটিন প্রবেশ করে এবং অপরদিক দিক দিয়ে বের হয়। তাহলে এটি স্পষ্ট যে, গলজি বস্তুর দুইটি প্রান্ত। যে প্রান্ত এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের সন্নিকটে অর্থাৎ প্রোটিন প্রবেশ করে তাকে সিস প্রান্ত (cis face) এবং যে প্রান্ত দিয়ে প্রোটিন অন্যান্য অঙ্গাণুতে যাবার উদ্দেশ্যে বের হয় তাকে ট্রান্স প্রান্ত (trans face) বলে। অর্থাৎ প্রোটিন সিস প্রান্ত দিয়ে গলজি বস্তুতে প্রবেশ করে ট্রান্স প্রান্ত দিয়ে বের হয়। চিত্র ৪.২-এ পুরো প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। 


চিত্র ৪.২: লাইসোসোমে প্রোটিন পরিবহন প্রক্রিয়া 

সিস প্রান্ত থেকে শুরু করে ট্রান্সে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রোটিনের বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটে। যেমন: এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে গ্লাইকোপ্রোটিন উৎপন্ন হওয়ার পর লুমেনে সামান্য পরিবর্তন ঘটে। এরপর গলজি বস্তুতে প্রবেশের পর গ্লাইকোপ্রোটিনের কিছু মনোমার বিমুক্ত হয় এবং অন্যান্য উপাদান যুক্ত হয়। ফলে কার্বোহাইড্রেটের গঠনের বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে।

উপরোক্ত আলোচ্য কাজ ছাড়াও গলজি বস্তু কিছু সংখ্যক ম্যাক্রোমৌল তৈরি করে। দেখা গেছে, কোষ যেসব পলিস্যাকারাইড নিঃসৃত করে তার অধিকাংশই গলজি বস্তুতে উৎপন্ন হয়। উদাহরণ হিসেবে পেকটিন ও সেলুলোজ দিয়ে গঠিত নয় এমন অন্যান্য পলিস্যাকারাইডের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব পলিস্যাকারাইড উদ্ভিদকোষের গলজি বস্তুতে উৎপন্ন হয় এবং পরবর্তীতে সেলুলোজের সাথে যুক্ত হয়ে কোষপ্রাচীরে জমা হয়। এছাড়াও কোষদেহে প্রোটিনের মত কিছু নন-প্রোটিন যৌগ নিঃসৃত হয়। এসব পদার্থ গলজি বস্তুর ট্রান্স প্রান্ত থেকে নিঃসৃত হয়ে কোষ ঝিল্লিতে জমা হয়। কিভাবে গলজি বস্তু বিভিন্ন পদার্থ উৎপাদন ও পরিশোধন করে তা জানতে সিস্টারনির কাছে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমে এসব পদার্থ একটি সিস্টারনি থেকে পরবর্তী সিস্টারনিতে পরিবাহিত হয় এবং প্রতিটি সিস্টারনিতে থাকা বিভিন্ন প্রকার এনজাইম এই কাজ সম্পাদন করে। এক্ষেত্রে এক সিস্টারনি থেকে অন্য সিস্টারনিতে প্রোটিন পরিবাহিত হয় এবং রূপান্তরিত হয়। তাহলে এই প্রক্রিয়ায় গলজি বস্তু স্থির থাকে, শুধু প্রোটিন এক সিস্টারনি থেকে অন্য সিস্টারনিতে গমন করে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে একদল বিজ্ঞানী বলেছেন ‘গলজি বস্তু নিশ্চল। এক্ষেত্রে গলজি বস্তুতে প্রোটিনের রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ভেসিকুলার ট্রান্সপোর্টেশন নামে অবহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে প্রোটিন ভেসিকুলারের মাধ্যমে গলজি বস্তুতে প্রবেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে সিস্টারনিতে প্রবেশের মাধ্যমে প্রোটিনের বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন সংঘটিত হয়। যখন এই তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে তখন অন্য একদল বিজ্ঞানী ভিন্ন মতামত প্রদান করেন। তাদের মতে গলজি বস্তু গাঠনিক দিক দিয়ে নিশ্চল নয়, এটি গতিশীল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী গলজি বস্তুতে প্রোটিনের রূপান্তর প্রক্রিয়াকে বলা হচ্ছেসিস্টারনাল মেচুরেশন। এক্ষেত্রে এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে আগত প্রোটিনের ভেসিকল গলজি বস্তুর সিস্টারনির মেমব্রেনের সাথে মিলিত হয়। পরবর্তীতে সিস্টারনির প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সিস প্রান্ত থেকে ট্রান্স প্রান্তে প্রোটিন পরিবাহিত হয়। এই গমন পথে প্রোটিনের বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন সংঘটিত হয়।

লাইসোসোম

লাইসোসোম হলো মেমব্রনে দিয়ে আবৃত থলি আকৃতি যেখানে হাইড্রোলাইটিক এনজাইম থাকে। প্রাণিকোষের লাইসোসোম হাইড্রোলাইটিক এনজাইমের মাধ্যমে ম্যাক্রোমৌলগুলোর পরিপাক ঘটায়। এককথায় লাইসোসোম বিভিন্ন ম্যাক্রোমৌল যেমন প্রোটিন, লিপিড, শর্করা প্রভৃতি ভেঙে সরল এককে পরিণত করে। কোষ যখন এসল মৌল শোষণ করে তখন লাইসোসোম থেকে নি:সৃত এনজাইম এদের ভেঙে ফলে কোষের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। বিষ্ময়কর বিষয় হলো কোষ এসব মৌল গ্রহণ না করলে লাইসোসোম কোষে বিদ্যমান বিভিন্ন অঙ্গাণু ভেঙে ফেলতে পারে। প্রতিনিয়ত লাইসোসোমের ক্রিয়া চলমান থাকে। লাইসোমের অভ্যন্তরে প্রায় ৫০ প্রকার এনজাইম থাকে, যা পলিমার যৌগের বিপাক ঘটায়। লাইসোসোমের এনজাইমগুলো সাধারণত অম্লীয় পরিবেশে বেশি সক্রিয় থাকে। যদি কোনো ভাবে লাইসোসোমের আবরণ ছিদ্র হয়ে এনজাইম বের হয়ে আসে, তাহলে তা আর আগের ন্যায় কাজ করতে পারে না। কারণ সাইটোসলের দ্রবণের ঘনমাত্রা নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ ঘনমাত্রায় এসব এনজাইম তার কার্যকারিতা হারায়। তবে লাইসোসোম থেকে অধিক মাত্রায় এনজাইম সাইটোসোলে নি:সৃত হলে তা কোষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ অধিক পরিমাণ এনজাইম সাইটোসলে জমা হলে তা কোষের অন্যান্য অঙ্গাণুকে মেরে ফেলবে। অর্থাৎ কোষ নিজেই নিজের অঙ্গাণুকে মেরে ফেলবে।

অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের মাধ্যমে হাইড্রোলাইটিক এনজাইম এবং লাইসোসোম তৈরি হয়ে পরবর্তীতে গলজি বস্তুর মাধ্যমে চূড়ান্ত আকার লাভ করে। লাইসোসোম বিভিন্ন প্রকার যৌগকে হাইড্রোলাইজ করে ভেঙে ফেলে সে ব্যাপারে আমরা জানলাম। লাইসোসোমের ভিতরের আবরণে অসংখ্য প্রোটিন থাকে। লাইসোসোম এনজাইম থেকে কিভাবে এসব প্রোটিন নিরাপদ থাকে? কারণ আমরা জানি লাইসোসোমে থাকা বিভিন্ন এনজাইম প্রোটিন জাতীয় পদার্থগুলোকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভেঙে ফেলে। হিসাব অনুযায়ী লাইসোসোম আবরণে থাকা এসব প্রোটিন ভেঙে যাওয়ার কথা।  অর্থাৎ হাইড্রোলাইটিক প্রকিয়ায় এসব মেমব্রেনের প্রোটিন ভেঙে লাইসোসোম নিষ্ক্রিয় হওয়ার কথা। কেন লাইসোমের আবরণী পর্দার অভ্যন্তর ভাগের প্রোটিন এনজাইমের প্রভাবে হাইড্রালাইসিস হয় না? লাইসোসোমের অভ্যন্তরের মেমব্রেনের প্রোটিন ত্রিমাত্রিক আকার গঠন করে, ফলে পানির অণু এসব বন্ধন ভাঙতে পারে না। ফলে লাইসোসোম কোষে আগত বিভিন্ন যৌগের বিপাক ঘটালেও নিজ দেহের প্রোটিন যৌগের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। চিত্র ৪.৩-এ কোষে থাকা লাইসোসোমের গঠন দেখানো হলো।

 

 



 

 

 

 

 


চিত্র ৪.৩: লাইসোসোমের গঠন 

 

জীবদেহে লাইসোসোম বিভিন্ন উপায়ে কার্য সম্পাদন করে। উদাহরণ হিসেবে আমরা অ্যামিবা ও বিভিন্ন প্রকার প্রোটিস্টের কথা বলতে পারি। এরা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকার ক্ষুদ্র অঙ্গাণু বা খাদ্য কণা গ্রহণ করে। গ্রিক শব্দ  phagein  বা খাদ্য গ্রহণে এবং kytos বা গহ্বর  (এক্ষেত্রে কোষ বুঝানো হয়েছে) হতে ফ্যাগোসাইটোসিস শব্দটির উৎপত্তি। মূলত এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য গ্রহণের জন্য একটি খাদ্য গহ্বর উৎপন্ন হয় যার মধ্যে দিয়ে খাদ্য প্রবেশ করে। খাদ্য গহ্বরের অপর প্রান্ত লাইসোসোমে মিলিত হয়। ফলে খাদ্য গহ্বরে আগত খাদ্য লাইসোসোমের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অতপর লাইসোসোমের এনজাইম খাদ্য কণার বিপাক ঘটায়। কোষদেহের লাইসোসোমে বিপাক ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন  যৌগ (সরল শর্করা, অ্যামাইনো এসিড ও অন্যান্য মনোমার) সাইটোসলে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে কোষের পুষ্টি উপাদান হিসেবে এসব যৌগ ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে ফ্যাগোসাইটোসিস শব্দটি ভিন্ন একটি অর্থ প্রকাশ করে। উন্নত প্রাণি দেহে বাহ্যিক আক্রমণ থেকে জীবদেহকে রক্ষা করতে একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রক্রিয়া অর্থে ফ্যাগোসাইটোসিস শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানবদেহের কোষে ফ্যাগোসাইটোসিস ঘটায় এমন কোষের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ম্যাক্রোফেজ (macrophages)। এটি এক প্রকার শ্বেত রক্ত কণিকা, যা বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকর অঙ্গাণু ধ্বংস করে দেহকে সুস্থ রাখে। চিত্র ১.৪.৪-এ লাইসোসোমের ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। চিত্রের (i) নং ধাপে হাইড্রোলাইটিক এনজাইম ধারণকারী লাইসোসোম দেখানো হয়েছে। (ii) নং ধাপে দেখা যাচ্ছে কোষের খাদ্য গহ্বর লাইসোসোমের সাথে যুক্ত হয়েছে। (iii) নং ধাপে খাদ্য উপাদানগুলো হাইড্রোলাইটিক এনজাইমের প্রভাবে বিপাক ঘটেছে। বিপাক ক্রিয়ার ফলে খাদ্য থেকে উৎপন্ন শক্তি কোষ গ্রহণ করে তার জৈবিক কাজ সম্পাদন করে। 

চিত্র ১.৪.৪: ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়া

এছাড়াও লাইসোসোম কোষের নিজস্ব অঙ্গাণুর বিপাক ঘটায়। মূলত কোনো অঙ্গাণু মৃত বা নিষ্ক্রিয় (স্বাভাবিক কার্য সম্পাদনে অক্ষম) হলে লাইসোসোম তার বিপাক ঘটিয়ে সরল উপাদানে রূপান্তর করে। কোষের নিজস্ব অঙ্গাণুর এ বিপাক প্রক্রিয়াকে অটোফ্যাগি (autophagy) বলে। অটোফ্যাগির সময় কোষের নিষ্ক্রিয় বা মৃত অঙ্গাণু দিস্তরবিশিষ্ট পর্দা দিয়ে আবৃত হয়। এরপর ঐ আবরণের বাইরের পৃষ্ট লাইসোসোমের যুক্ত হয়। এরপর লাইসোসোমের এনজাইম অঙ্গাণুর বিপাক ঘটায়। চিত্র ৪.৫-এ কোষের অটোফ্যাগি প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। চিত্রের (a) নং ধাপে দেখা যাচ্ছে নিষ্ক্রিয় অঙ্গাণু ধারণকারী গহবরের সাথে লাইসোসোম যুক্ত হয়েছে। (b) নং ধাপে হাইড্রোলাইটিক এনজাইম নিষ্ক্রিয় অঙ্গাণুর বিপাক ঘটিয়েছে।

চিত্র ৪.৫ : অটোফ্যাগি প্রক্রিয়া

মৃত অঙ্গাণুর বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন জৈব মনোমার সাইটোসলে ফিরে আসে। এভাবে লাইসোসোমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত কোষে রিসাইক্লিং (মৃত অঙ্গাণুর বিপাকে সরল যৌগে রূপান্তর প্রক্রিয়া) চলতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ- প্রতি সপ্তাহে মানবদেহের যকৃত কোষের অর্থেক ম্যাক্রোমৌলের রিসাইক্লিং ঘটে।

কোষ গহ্বর

কোষীয় পর্দা দিয়ে গঠিত জীবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু কোষ গহ্বর। প্রতিটি কোষে এর উপস্থিতি বিদ্যমান। উদ্ভিদ কোষে এর আকার বড় হলেও, প্রাণিকোষের কোষ গহ্বর আপেক্ষিকভাবে ছোট হয়। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ও গলজি বস্তু থেকে উৎপন্ন হওয়া মেমব্রেনের মধ্যে কোষ গহ্বর সবচেয়ে বড়। অন্যান্য কোষীয় ঝিল্লির মতই কোষ গহ্বর নির্দিষ্ট দ্রব্য পরিবহণ করে। ফলে এর অভ্যন্তরের পরিবেশ কোষের সাইটোসল থেকে ভিন্ন। কারণ কোষ গহ্বরের মধ্যে যে সকল পদার্থ থাকে তাদের কার্যক্রম ও সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজনীয় ঘনমাত্রা, তাপমাত্রা, pH মান বাইরের পরিবেশ থেকে ভিন্ন। কোষের অবস্থানকারী এই গহ্বর একটি ফাঁকা প্যাকেটের মত মনে হলেও বিষয়টি এমন নয়। এটি কোষের বিভিন্ন প্রকার কাজ সম্পাদন করে। কোষের প্রকৃতি ভেদে কোষ গহ্বরের কাজের ধরণ ভিন্ন হয়। একইভাবে কাজের ধরণ অনুযায়ী এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। অ্যামিবা ও প্রোটিস্ট ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় খাদ্য গ্রহণে নিজ দেহে এক প্রকার গহ্বর তৈরি করে যা খাদ্য গহ্বর (Food vacuoles নামে পরিচিত।

অনেক সাধু পানির প্রোটিস্টের দেহে সংকোচনশীল গহ্বর (contractile vacuoles থাকে। এর মাধ্যমে প্রোটিস্ট তার দেহ থেকে অতিরিক্ত পানি দেহের বাইরে নিঃসরণ করে। ফলে কোষ দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রকার আয়ন ও যৌগের ঘনমাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কিছু কিছু উদ্ভিদ ও ছত্রাকের দেহে বিশেষ ধরনের গহ্বর পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এর মধ্যে বিদ্যমান এনজাইম হাইড্রোলাইসিস ঘটায়। অনেকটা প্রাণিকোষে বিদ্যমান লাইসোসোমের মত। তবে অনেক বিজ্ঞানীরা বলছেন হাইড্রোলাইটিক গহ্বর বলে কিছু নেই, এটি এক প্রকার লাইসোসোম যা উদ্ভিদ ও ছত্রাকের দেহে পাওয়া যায়। উদ্ভিদ দেহে কিছু কিছু ক্ষুদ্র গহ্বর বিদ্যমান যা প্রয়োজনীয় জৈব যৌগ সঞ্চয় করে। যেমন: বীজের কোষে জমানো প্রোটিন। কিছু কিছু গহ্বর বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত পদার্থ সঞ্চয় করে। ফলে তা বিভিন্ন তৃণভোজী জীবের আক্রমণ থেকে উদ্ভিদকে রক্ষা করে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে কোষদেহে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রকার উপাদানের এমন বৈশিষ্টের ওপর ভিত্তি করেই ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। এখনও আমরা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে সরাসরি উদ্ভিদের কান্ড,পাতা, ফুল, ফল ব্যবহার করতে দেখি। উদাহরণ হিসেবে রক্ত জমাট বাঁধতে দুর্বা ঘাস বা গাঁদা ফুলের পাতার ব্যবহার আমরা সচরাচর দেখে থাকি। এছাড়াও কিছু কিছু গহ্বর বিভিন্ন প্রকার পিগমেন্ট ধারণ করে যা বর্ণ প্রদর্শন করে। বিশেষ করে এর উপস্থিতিতে ফুলের পাঁপড়ির রঙ ভিন্ন হয়। কোনোটা আমাদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়, কোনোটা সুগন্ধী ও বিশ্রী লাগে। যদিও আমরা গোলাপ, টিউলিপ, রজনীগন্ধা ফুল প্রতিনিয়ত উপহার দিয়ে থাকি।  ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের জন্য দায়ী বিভিন্ন প্রকার পিগমেন্ট। ফুলের পাঁপড়িতে থাকা পিগমেন্ট পরাগায়নে সবচেয়ে সহায়ক কৌশল হিসেবে কাজ করে। পাঁপড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন প্রকার পতঙ্গ মধু সংগ্রহ করতে আসে। সেই সাথে তাদের পা বা শরীরে লেগে থাকা রেণু পুরুষ ফুল থেকে স্ত্রী ফুলে পরিবাহিত হয়। তবে সব ফুলে যে মধু থাকবে এমনটি নয়। আবার সব ফুলের পরাগায়ন কীট-পতঙ্গ বা পোকামাকড় দিয়ে হবে এমনটিও নয়। ধানের ফুলের পুরুষ রেণু এমন যেন তা বাতাসে ভেসে যেতে পারে। একইভাবে কিছু ফুলের পরাগায়ন পানির মাধ্যমে হয়ে থাকে।

একটি প্রাপ্ত বয়স্ক উদ্ভিদ কোষে বৃহৎ একটি কেন্দ্রীয় গহ্বর থাকে। চিত্র ৪.৬-এ উদ্ভিদ কোষের গহ্বরের গঠন দেখানো হয়েছে।  


চিত্র ৪.৬ : উদ্ভিদের কেন্দ্রীয় গহ্বর

 

ক্ষুদ্র একটি কোষ গহ্বর বিবর্ধিত হয়ে বৃহৎ আকার ধারণ করে। কেন্দ্রীয় গহ্বরের অভ্যন্তরের দ্রবণকে কোষ রস (Cell Sap) বলে। কোষ রসে পটাসিয়াম ও ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন প্রকার অজৈব আয়ন থাকে। মূলত এটি অজৈব আয়নের প্রধান ভান্ডার। কোষের বৃদ্ধিতে কোষ গহ্বর গুরুত্বর্পণ ভূমিকা পালন করে। পানি গ্রহণের মাধ্যমে এটি আকারে বড় হয়। ফলে কোষের আকার বৃদ্ধি পায়। এতে সাইটোপ্লাজমের বৃদ্ধি সামান্য ঘটলেও কোষ অনেক বড় আকার লাভ করতে পারে। অনেক সময় সাইটোসল কোষ ঝিল্লি ও কেন্দ্রীয় গহ্বরের মধ্যে একটি পাতলা আবরণ তৈরি করে। ফলে উদ্ভিদ কোষ অনেক বড় হলেও কোষ ঝিল্লির পৃষ্টতল ও সাইটোসলের আয়তনের অণুপাত পর্যাপ্ত থাকে। কারণ এ অণুপাত পর্যাপ্ত না হলেও কোষের আকার ভেঙে যায়।

 

এন্ডোমেমব্রেনর সম্পর্কে কী জানলে? নিজেকে যাচাই করতে নিজের দক্ষতা লেভেল জানার জন্য মনযোগ দিয়ে পড় ও মডেল টেস্ট দাও। পরবর্তীতে মডেল টেস্ট নেওয়া হবে।

সূত্র: Campbell Biology (মূল ক্যাম্পবেল বায়োলজির কোষ ইউনিট নিয়ে বাংলায় “ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) প্রকাশ করেছে ল্যাববাংলা প্রকাশনী)

জীববিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানতে ও জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হতে ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট) ও ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) বই দুইটি পড়তে পারো।

 

 

 


Blogger দ্বারা পরিচালিত.