-->

আগামী দিনের টেকসই খাবার

প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন প্রকার খাবার গ্রহণ করি। অঞ্চল এবং জায়গা ভেদে খাবারের প্রকৃতি ভিন্ন হলেও খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য অভিন্ন। বেঁচে থাকার তাগিদে তথা শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যোগান দেওয়ার জন্য আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকার খাবার গ্রহণ করতে হয়। তাই আমাদের খাদ্য তালিকায় ভাত, রুটি, সবজি, মাছ, মাংসের সাথে ফল, দুধ থাকে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি মানুষ বিভিন্ন প্রকার খাদ্য গ্রহণ করে আসছে। তবে সময়ের সাথে সাথে এই খাবারের ধরণ ভিন্ন হয়েছে। মানুষের অনুসন্ধান, উদ্ভাবন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে ফসল উৎপাদন এবং খাদ্য গ্রহণের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় আমরা যে খাবার গ্রহণ করছি, আগামী পঞ্চাশ বা একশত বছর পর অনেক খাবার থাকবে না। অনেক খাবার খাদ্য অভ্যাসের কারণে পরিবর্তিত হবে। আবার অনেক খাবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র ১৩টি ফসল বর্তমান পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দেয়। পাশাপাশি আমরা দেহ চালনায় প্রয়োজনীয় শক্তির অর্ধেক আসে গম, ভুট্টা ও চাল থেকে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এসব ফসলের অধিকাংশ আগামীতে আবাদ করা সম্ভব  হবে না। আগামীর বিরুপ অবস্থায় বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রা, অসম বৃষ্টিপাত এবং চরম জলবায়ুর প্রভাবে অধিকাংশ ফসল টিকে থাকতে পারবে না। ইতিমধ্যে খড়া, বন্যা ও তাপদাহের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক মাত্রায় ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অবশ্যই আগামী দুনিয়ায় আমাদের খাবার পরিবর্তন করতে হবে। এমন মতামত প্রদানকারী একজন বিজ্ঞানী হলেন ফেস্টো মাসাউয়ে যিনি খাদ্য অভ্যাসের উপর জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন খাদ্য অনুসন্ধান করতে হবে। বিজ্ঞানীরা এই লক্ষ্য পূরণে বিভিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল জাত উদ্ভাবন, জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে টিকে থাকে এমন ফসল অনুসন্ধান করে চলেছেন। আগামীর জনবহুল বিশ্বকে খাদ্য যোগান দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা ফসল উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবনে প্রতিনিয়ত গবেষণা করছেন।

নতুন নতুন খাদ্য বা ফসল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। একটি নতুন জাত বা খাবার নতুন মেন্যু উদ্ভাবন করলে তা ভোক্তা গ্রহণ করবে বিষয়টি এমন নয়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মৎসবিজ্ঞানী হ্যালে ফ্রহেলিস বলেন, “খাদ্য উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ভোক্তার সাথে একটি সমীকরণে মিল থাকতে হয়। এটি ভোক্তার চাহিদার সাথে মিলতে হবে, দেখতে আকর্ষণীয় হতে হবে, সুস্বাদু হতে হবে এবং মূল্য সহনশীল হতে হবে।”

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তনের সাথে সাথে আগামী দিনে আমাদের খাবারের টেবিলে নতুন নতুন খাদ্য যোগ হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যে সকল ফসল টিকে থাকবে এবং আমাদের রুচির সাথে সমন্বয় রাখতে পারবে, সেগুলোই হবে আমাদের খাবার। আগামীর দুনিয়ায় কোন কোন খাবারের সাথে পরিচয় হবে তা নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। তবে আমাদের আলোচনায় ছয়টি ফসল থাকবে যা আগামী বিশ্বের খাদ্য তালিকায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

১) বাজরা বা মিলেট (Millet)

চিত্র: দানাদার ফসল মিলেট বা বাজরা
মিলেট এক প্রকার দানাদার ফসল। Poaceae গোত্রের এই ফসল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকার মিলেট আবাদ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশে ‘ভুরো’ নামে মিলেট আবাদ হয়। মানুষের খাবারের পাশাপাশি গোখাদ্য হিসেবে মিলেট জনপ্রিয়। মিলেট কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, খনিজ (পটাশিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম) সরবারহ করে।খাদ্য হিসেবে মিলেটের দানা, গ্লুটোন মুক্ত ময়দা, পাস্তা, চিপস হিসেবে মিলেট গ্রহণ করা হয়। ধারণা করা হয় ১০,০০০ বছর র্পূবে এশিয়ায় মিলেট আবাদ হতো। তাই এশিয়া অঞ্চল মিলেটের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়। ফলে এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশে মিলেট প্রধান খাবার হিসেবে পরিচিত। গম, ভুট্টা বা ধানের তুলনায় মিলেট অধিক মাত্রায় জলবায়ু সহনশীল। এটি উচ্চ তাপমাত্রায়, পানি সংকট এলাকা এমনকি খরাপ্রবণ এলাকায় জন্মাতে পার। পাশাপাশি দানাদার জাতীয় ফসলে আক্রমণ করে এমন অনেক রোগ ও পোকামাকড় মিলেটে দেখা যায় না। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে মিলেট আবাদ জনপ্রিয় হচ্ছে এবং অদুর ভবিষ্যতে এটি একটি জনপ্রিয় খাবার হিসেবে খাদ্য তালিকার প্রথম দিকে থাকবে।

২) বামবারা গ্রাউন্ডনাট (Bambara Groundnut)

চিত্র: নাইট্রোজেন সংবন্ধনে সক্ষম বামবারা গ্রাউন্ডনাট
বামবারা গ্রাউন্ডনাট Fabaceae গোত্রের লিগুম জাতীয় ফসল। আমাদের দেশে লিগুম জাতীয় ফসল হিসেবে মশুর, মাসকলাই, মুগ আবাদ হয়। বামবারা গ্রাউন্ডনাট আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে আবাদ হয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে এর আদি নিবাস বিবেচনা করা হয়। তবে আফ্রিকার অধিক উষ্ণ দেশগুলোতে বামবারা গ্রাউন্ডনাট আবাদ করা হয়। এর দীর্ঘ প্রধান মূলে নাইট্রোজেন ফিক্সেশন উপযোগী লিগুউম থাকে। ফলে এটি বাতাসের নাইট্রোজেন সংবন্ধন ঘটাতে পারে। ফলে যে সকল মাটিতে নাইট্রোজেনের ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই ফসল সহজে আবাদ করা যায়। বামবারা গ্রাউন্ডনাট প্রোটিনের অন্যতম উৎস। এছাড়াও এটি ফাইবার, খনিজ পদার্থ (পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রন) যোগান দেয়। খাদ্য হিসেবে বামবারা গ্রাউন্ডনাটের বহুরূপী ব্যবহার রয়েছে। এটি সিদ্ধ অবস্থায়, গ্লুটিন মুক্ত ময়দা বা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়।

৩) ঝিনুক (Mussels)

চিত্র: প্রোটিনের আঁধার সামুদ্রিক ঝিনুক
প্রোটিন, ওমেগা-৩, ভিটামিন বি ১২ ও খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে সামু্দ্রিক ঝিনুক ব্যাপক জনপ্রিয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মানুষের খাদ্য তালিকায় নিয়মিতভাবে ঝিনুক দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালে জনপ্রিয় বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সামুদ্রিক খাবারের শতকরা ৪০ ভাগ ঝিনুক এবং অন্যান্য শামুকজাতীয় জীব দখল করবে। এটা সত্য যে খাদ্য পুষ্টির পাশাপাশি শামুক জাতীয় এসকল জীবের খামারিরা বেশ লাভবান হচ্ছেন।

৪) এনসেট (Enset)

চিত্র: মিথ্যা কলাগাছ নামে পরিচিত এনসেট
কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও জিংকের বৃহৎ উৎস হিসেবে এনসেট খুব জনপ্রিয়। এটি এক প্রকার উদ্ভিদ দেখতে কলা গাছের মতো। তবে এই গাছের ফল খাওয়া হয়। এনসেটের ফল অনেকটা আলুর মতো। খরা সহনশীল এই উদ্ভিদ ইথিওপিয়াতে ব্যাপক আবাদ হয়। স্থানীয়ভাবে এনসেটকে মিথ্যা কলাগাছ বলে ডাকা হয়। এনসেটকে ‘ট্রি এগেনেস্ট হাঙ্গার’ বলা হয়ে থাকে। কারণ বছরের যে কোনো সময় এর কান্ড খাবার হিসেবে গ্রহণ করা যায়। সময়ের সাথে এনসেটের আবাদ বিস্তৃত হচ্ছে। ২০২১ সালে “এনভায়রনমেন্টাল রিসার্স লেটার” প্রকাশ করেছে যে, এনসেট আফ্রিকার অন্যান্য দেশে বিস্তৃত হতে পারে।

৫) কেল্প (Kelp)

 

চিত্র: পুষ্টিকর শৈবাল কেল্প
কেল্প হলো সমুদ্রের গভীরে জন্মানো এক প্রকার শৈবাল। ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ এই শৈবাল খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। সালাদ, সালসা, নুডলস বা চিপস রূপে কেল্প খাওয়া হয়। ঠান্ডা পরিবেশে কেল্প টিকে থাকতে পারে। সালোকসংশ্লেষণের সময় কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে কেল্প চারপাশের অম্লীয় মাত্রা কমাতে পারে। মেইন এবং আলাস্কার কৃষকেরা কেল্প ও ঝিনুক একসাথে আবাদ করে। হাজার বছর ধরে এশিয়ার দেশগুলোতে কেল্প খাদ্য হিসেবে ব্যপক জনপ্রিয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতেও এখন কেল্প খাবার হিসেবে মানুষ গ্রহণ করছে।   

৬) ক্যাসাভা (Cassava)

চিত্র: পুষ্টির ডিনামাইট ক্যাসাভা
ক্যাসাভা, শর্করা জাতীয় সবজি। মূল রূপান্তরের মাধ্যমে ক্যাসাভা ভক্ষনযোগ্য অংশ তৈরী হয়। কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই খাবারের আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। পরিবেশ সহনশীলতা ও খাদ্য গুণের কারণে বিশ্বের ১০০ টি দেশে ক্যাসাভা আবাদ হয়। ক্যাসাভা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে এবং এটি খরা ও লবণাক্তকা সহনশীল উদ্ভিদ। কাঁচা ক্যাসাভাতে ক্ষতিকর সায়ানাইড থাকে। তবে ক্যাসাভা সংগ্রহের পর এর বাকল ফেলে দিলে, সিদ্ধ করলে এই পদার্থ নির্মূল হয়।

অনুবাদঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম: বিজ্ঞান কর্মী ও লেখক, প্রকাশিত বইঃ বীজগণিত সমগ্র (১ম ও ২য় খন্ড), ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট), ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট)।

সূত্রঃ সায়েন্স নিউজ, হেল্থ লাইন, নেচার, সায়েন্স ডেইলি, ফ্রন্টিয়ার, ফিডপিডিয়া, বিবিসি।  

Blogger দ্বারা পরিচালিত.