কোষবিদ্যা-০৩: নিউক্লিয়াস ও রাইবোসোম
অপরদিকে সাইটোপ্লাজমে থাকা একটি ক্ষুদ্র অঙ্গাণু রাইবোসোম। এই দুইটি অঙ্গাণু কোষের জেনেটিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত। আপাতত জিন সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নেওয়া যাক। কোনো জীবের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা নির্ধারণ করে এই জিন। ভিন্ন ভিন্ন জেনেটিক নির্দেশনার কারণেই কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ অধিক বুদ্ধিমান, কেউ কম বুদ্ধিমান, কারো চুল কালো, আবার কেউ কেউ স্বর্ণকেশী হয়। মূলত জিন ডিএনএ-এর বিশেষ অংশ, যা নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। এককথায় অধিকাংশ ডিএনএ-এর আবাসস্থল হলো নিউক্লিয়াস। অন্য অঙ্গাণুটি রাইবোসোম, যা ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রোটিন তৈরী করে। তাই রাইবোসোমকে প্রোটিনের রান্নাঘর বলা হয়।
নিউক্লিয়াস: জেনেটিক নির্দেশনার কেন্দ্রবিন্দু
একটি ইউক্যারিওটিক কোষের অধিকাংশ জিন নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। তবে কিছু জিন কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্টে (উদ্ভিদকোষ) দেখা যায়। আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের দিয়ে দেখলে কোষের সব অঙ্গাণুর মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ও ঘন গোলাকার অংশটি দেখা যায়, সেটা হলো নিউক্লিয়াস [চিত্র ১]। এটার গড় ব্যাস ৫ μm.
নিউক্লিয়াস একটি ঝিল্লি দিয়ে আবৃত থাকে, যা নিউক্লিয়ার ঝিল্লি নামে পরিচিত। এটা দ্বিস্তরবিশিষ্ট, অর্থাৎ পাশাপাশি দুইটি ঝিল্লি অবস্থান করে। চিত্র ১-এ একটি ইউক্যারিওটিক কোষের গঠন দেখানোর পাশাপাশি এর নিউক্লিয়াসের গঠন দেখানো হয়েছে।
চিত্র ১: একটি ইউক্যারিওটিক কোষ ও এর বিভিন্ন অঙ্গাণু
নিউক্লিয়ার ঝিল্লি প্রোটিন ও লিপিড দিয়ে তৈরী। নিউক্লিয়ার ঝিল্লিতে ১০০ nm ব্যাস বিশিষ্টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে, যাকে নিউক্লিয়ার ছিদ্র বলা হয়। মূলত এই ছিদ্রের মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভেতরের সাথে সাইটোপ্লাজমের যোগাযোগ সম্পন্ন হয়। বিশেষ ধরনের প্রোটিনের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কাজ সম্পন্ন হয়। নিউক্লিয়ার ঝিল্লির প্রতিটি ছিদ্রে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন অবস্থান করে। এই ছিদ্র প্রোটিন, আরএনএ ও বিভিন্ন ধরনের ম্যাক্রোঅণু পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে। ছিদ্র ব্যতীত নিউক্লিয়ার ঝিল্লির অভ্যন্তর পাশে নিউক্লিয়ার ল্যামিনা নামক এক প্রকার উপাদান থাকে। এটি জালের মত দেখতে এক প্রকার প্রোটিনের স্তর, যা নিউক্লিয়াসের সঠিক আকৃতি প্রদানের পাশাপাশি নিউক্লিয়ার ঝিল্লির সঠিক কাঠামো বজায় রাখতে সহযোগিতা করে। এছাড়াও নিউক্লিয়াসের ভেতরে নিউক্লিয়ার ম্যাট্রিক্স নামক প্রোটিন তন্তু দেখা যায়। নিউক্লিয়ার ল্যামিনা ও ম্যাট্রিক্স সমন্বিতভাবে জেনেটিক উপাদানের বিন্যাস ও সঠিকভাবে এটির কার্য সম্পাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। চিত্র ২-একটি নিউক্লিয়াসের গঠন আলোচনা করা হয়েছে।
চিত্র ২: নিউক্লিয়াস ও তার আবরণী ঝিল্লি
নিউক্লিয়াসের মধ্যে সূতার মতো অঙ্গাণুতে ডিএনএ অবস্থান করে। সূতার মতো এই অঙ্গাণুটি হলো ক্রোমোসোম, যা জিনতাত্ত্বিক তথ্য পরিবহন করে। প্রতিটি ক্রোমোসোম একটি দীর্ঘ ডিএনএ অণু ধারণ করে। প্রতিটি ডিএএনএর সাথে অসংখ্য প্রোটিন যুক্ত থাকে। এসব প্রোটিন বিভিন্ন ধরনের কার্য সম্পাদন করে। কিছু প্রোটিন লম্বা ডিএনএ-কে এমনভাবে ভাঁজ করে যেন তার দৈর্ঘ্য হ্রাস পায় এবং নিউক্লিয়াসের মধ্যে সঠিকভাবে অবস্থান করতে পারে। আর এসব প্রোটিন ও ডিএনএ এক সাথে অবস্থান করে সূতার মতো জমাট অঙ্গাণুর সৃষ্টি করে, যা হলো ক্রোমাটিন। প্রতিটি প্রোটিন ও ডিএনএ-এর মিশ্রণ হলো ক্রোমাটিন। কোষ বিভাজনের সময় আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে ক্রোমাসিম, ক্রোমাটিন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কোষের নিউক্লিয়াস নিয়ে আলোচনার সময় আমরা ক্রোমোসোম, ক্রোমাটিড ও ক্রোমাটিন শব্দটি খুব ব্যবহার করে থাকি। এদের মধ্যকার মূল পার্থক্য কি? একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই প্রশ্নটির উত্তর স্পষ্ট করা যাক।
মনে করো তোমার হাতে ৫০টি প্যাচানো সূতা (দুইটি সূতা পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে দেখতে একটি মনে হবে) আছে। আলাদা আলাদাভাবে ৫০টি সূতা তুমি পাশাপাশি রাখলে। এবার ৫০টি সূতা একসাথে এমনভাবে প্যাঁচিয়ে জড়ো করে রাখলে যেন প্রতিটি সূতা অন্যান্য সূতার সাথে পাঁকানো অবস্থায় থাকে। তাহলে কি দেখলে? প্রথমে ৫০টি আলাদা সূতা, আর পরবর্তীতে একসাথে জড়ো করা সূতা। প্রতিটি সূতা হলো এক একটি ক্রোমোসোম, যা ডিএনএ ও বিশেষ প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত। আর জড়ো পাকানো সূতা হলো ক্রোমাটিন। ক্রোমোসোম মূলত দুইটি সূতার সমন্বয়ে গঠিত অর্থাৎ দুইটি বাহুর মিলিত গঠন। প্রতিটি বাহুকে ক্রোমাটিড বলে। বিভাজন শুরু হয় নি এমন একটি কোষকে অণুবীক্ষণযন্ত্রে দেখলে ক্রোমাটিনকে কেমন দেখাবে? দেখা যাবে জমাটবদ্ধ গাড় এলাকা এবং এই অবস্থায় প্রতিটি ক্রোমোসোমকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যাবে না। এই অবস্থায় অসংখ্য ক্রোমোসোম জমাটবদ্ধ অবস্থায় থাকে, যা ক্রোমাটিন। বিভাজন শুরু হওয়া মাত্র ক্রোমাটিনের প্রতিটি ক্রোমোসোম পাঁক খায় এবং আকারে ছোট ও মোটা হতে থাকে। এক পর্যায়ে ক্রোমোসোমগুলো স্পষ্ট হয়। সাধারণত মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মেটাফেজ দশায় ক্রোমোসোমগুলো সর্বাধিক স্পষ্ট হয়। প্রতিটি ইউক্যারিওটিক কোষে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোসোম অবস্থান করে। যেমন: মানুষের দেহকোষের নিউক্লিয়াসে ৪৬টি ক্রোমোসোম থাকে।
নিউক্লিয়াসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু ক্রোমোসোম হলেও সবচেয়ে স্পষ্ট অঙ্গাণু নিউক্লিওলাস (বহুবচনে নিউক্লিওলি)। অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখলে গোলাকার ঘন অঞ্চল হিসেবে নিউক্লিয়াসকে দেখা যায়। তেমনি ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে নিউক্লিয়াসকে পর্যবেক্ষণ করলে গাঢ় গোলাকার অঞ্চল দেখা যাবে। আর এটিই হলো নিউক্লিওলাস । এখানে ডিএনএ-এর নির্দেশনা অনুযায়ী রাইবোসোমাল আরএনএ সংশ্লেষিত হয়।
সাইটোপ্লাজম থেকে আসা এক প্রকার প্রোটিনের সাথে রাইবোসোমাল আরএনএ যুক্ত হয়ে রাইবোসোমের বৃহৎ ও ক্ষুদ্র ইউনিট গঠন করে। এরপর তা নিউক্লিয়ার ছিদ্র দিয়ে নিউক্লিয়াসের বাইরে বের হয়ে আসে। এরপর নিউক্লিওলাস থেকে আসা রাইবোসোমের বৃহৎ ও ক্ষুদ্র ইউনিটগুলো যুক্ত হয়ে রোইবোসোম গঠন করে। আমরা জানি রাইবোসোম হলো প্রোটিনের কারখানা। ডিএনএ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা অনুযায়ী রাইবোসোম প্রোটিন তৈরী করে। আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি, ডিএনএ থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী মেসেনজার আরএনএ সংশ্লেষিত হয়, যা নিউক্লিয়ার ছিদ্র দিয়ে রাইবোসোমে প্রবেশ করে। অতপর মেসেঞ্জার আরএনএর সংকেত অনুযায়ী রাইবোসোমে প্রোটিন তৈরি হয়।
রাইবোসোম: প্রোটিনের কারখানা
কোষের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণুগুলোর একটি রাইবোসোম। এটি এমন একটি অঙ্গাণু, যা প্রোক্যারিওটিক ও ইউক্যারিওটিক উভয় কোষে পাওয়া যায়। নিশ্চয় অবাক হচ্ছ! আসলে হওয়ারই কথা। কিন্তু মূল বিষয় হলো কোনো কোষের দেহ গঠিত হওয়ার প্রধান উপাদান হলো প্রোটিন। আর কোষের অভ্যন্তরে এ প্রোটিন সংশ্লেষিত হওয়ার একমাত্র স্থান হলো রাইবোসোম। কোষের মধ্যে অবস্থিত ক্ষুদ্র অঙ্গাণু রাইবোসোমে প্রোটিন তৈরি হয়। রাইবোসোমাল আরএনএ এবং প্রোটিন দিয়ে গঠিত এ অঙ্গাণু প্রোটিন সংশ্লেষ করে। চিত্র ৩-এ রাইবোসোমের গঠন দেখানো হয়েছে। একটি কোষে কি সংখ্যক রাইবোসোম থাকবে তা কোষ অনুযায়ী ভিন্ন হয়। সাধারণত যেসব কোষে অধিক হারে প্রোটিনের সংশ্লেষণ ঘটে, সেসব কোষে রাইবোসোম সংখ্যা বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের অগ্ন্যাশয়ের কোষে কয়েক মিলিয়ন রাইবোসোম থাকে।
তাহলে এই বিষয়ে আমরা একটা ধারণা লাভ করলাম যে, রাইবোসোমে প্রোটিন সংশ্লেষিত হয়। তবে কোষের সাইটোপ্লাজমের দুইটি অঞ্চলে প্রোটিনের সংশ্লেষণ ঘটে থাকে। তাহলে কোষের সাইটোপ্লাজমের কয়েকটি অংশে রাইবোসোম থাকে। রাইবোসোম যেখানে অবস্থান করবে সেখানেই প্রোটিনের সংশ্লেষণ ঘটবে।
দেখা যায় কোনো একটি কোষে মুক্ত রাইবোসোম ও বদ্ধ রাইবোসোম একই সাথে অবস্থান করে। সাধারণত কোষের সাইটোসলে (সাইটোপ্লাজমের অঙ্গাণু) রাইবোসোম মুক্তভাবে অবস্থান করে। অপরদিকে নিউক্লিয়ার আবরণী ঝিল্লি অথবা এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের গাত্রে রাইবোসোম দানা যুক্ত থাকে, যা রাইবোসোমের আবদ্ধ রূপ। গাঠনিক দিক দিয়ে এই দুই ধরনের রাইবোসোমের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী রাইবোসোম এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। মুক্ত রাইবোসোমে যেসব প্রোটিন উৎপন্ন হয় তার অধিকাংশ সাইটোসল অঞ্চলে সক্রিয় থাকে। উদাহরণ হিসেবে আমরা কিছু এনজাইমের কথা বলতে পারি যা শর্করার ভাঙন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে সক্রিয় থাকে। অপরদিকে আবদ্ধ রাইবোসোমে যেসব প্রোটিন উৎপন্ন হয় তা কোন অঙ্গাণুর ঝিল্লির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অথবা কোন অঙ্গাণু থেকে বাইরের দিকে নিঃসরিত হয়। উদাহরণ হিসেবে লাইসোসোমের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রোটিন অঙ্গাণু থেকে নিঃসরিত হয় তার একটি উদাহরণ হতে পারে অগ্ন্যাশয়।
নিউক্লিয়াস ও রাইবোসোম সম্পর্কে কী জানলে? নিজেকে যাচাই করতে নিজের দক্ষতা লেভেল জানার জন্য মনযোগ দিয়ে পড় ও মডেল টেস্ট দাও। আগামীকাল গুগল ফরমে পরীক্ষা নেওয়া হবে।
সূত্র: Campbell Biology (মূল ক্যাম্পবেল বায়োলজির কোষ ইউনিট নিয়ে বাংলায় “ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) প্রকাশ করেছে ল্যাববাংলা প্রকাশনী)
জীববিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানতে ও জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হতে ক্যাম্পবেল বায়োলজি (প্রাণরসায়ন ইউনিট) ও ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) বই দুইটি পড়তে পারো।