-->

কোষবিদ্যা -০১: কোষ গবেষণায় ব্যবহৃত মাইক্রোস্কোপির গল্প

কোষ খালি চোখে দেখা যায় না। তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে কোষের গঠন ব্যখ্যা করেন? কিভাবে বিজ্ঞানীরা কোষের ভিতরের বিভিন্ন উপাদান ও তাদের রাসায়নিক ক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন? কোষ নিয়ে বিস্তারিত জানার পূর্বে কিভাবে কোষ নিয়ে গবেষণা করা হয় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মাইক্রোস্কোপি

প্রতিটি জীবের দেহে কোটি কোটি কোষের সমাহার। অথচ আলাদাভাবে কোনো একটি কোষকে খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। আমাদের কোনো ইন্দ্রিয়ই এতোটা উন্নত নয় যে, তাদের মাধ্যমে আমরা কোষকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারবো। সময়ের সাথে বিভিন্ন যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে আমার কোষ নিয়ে অনেক তথ্য জানতে পেরেছি। ১৫৯০ সালে চশমা প্রস্তুতকারী হ্যান্স ও জাকারিয়া জনসনের জটিল অণুবীক্ষণযন্ত্রের (Microscope) উদ্ভাবনের ফলে কোষ নিয়ে গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। পরবর্তীতে তাদের উদ্ভাবিত অনুবীক্ষণযন্ত্র সময়ের সাথে আরোও উন্নত হয়। সর্বপ্রথম তাঁদের উদ্ভাবিত অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে কুষ্ঠ রোগের জীবাণু সনাক্ত করা হয়েছিল। এটার বিবর্ধন ক্ষমতা ছিল ৩-১০x। এই অণুবীক্ষণযন্ত্রের অনেক অসুবিধা থাকা স্বত্ত্বেও এটার মূলনীতি ব্যবহার করে আজকের আধুনিক অণুবীক্ষণযন্ত্র উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। চিত্র ১.১.১-এ হ্যান্স ও জাকারিয়া জনসনের জটিল অণুবীক্ষণযন্ত্রের চিত্র দেখানো হলো।  

চিত্র ১.১: হ্যান্স ও জনসন অণুবীক্ষণযন্ত্র


 
১৬৬৫ সালে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী রবার্ট হুক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে কোষ দেখতে পান। অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে তিনি ওক গাছের বাকলের মৃত কোষ পর্যবেক্ষণ করেন এবং মোটামুটি ¯পষ্টভাবে কোষপ্রাচীর দেখতে পান। রবার্ট হুক যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেন তার বিবর্ধণ ক্ষমতা ছিল ৩০ x । চিত্র ১.২-এ রবার্ট হুকের কোষ পর্যবেক্ষণ ও ব্যবহৃত অণুবীক্ষণ যন্ত্র দেখানো হলো।  

চিত্র.১.২: রবার্ট হুকের পর্যবেক্ষণকৃত কোষ ও অণুবীক্ষণ

তবে সজিব কোষকে দেখার জন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল অ্যান্থনি ভন লিউয়েনহুক এর নিপুণ হাতে গড়া উন্নত অণুবীক্ষণযন্ত্রের জন্য। ১৬৭৪ সালে রবার্ট হুক বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ভন লিউয়েন হুকের সাথে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের এক পর্যায়ে অ্যান্থনি ভন লিউয়েন হুক রবার্ট হুককে তাঁর তৈরি অণুবীক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে পানিতে ভেসে বেড়ানো অতি ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণিকুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এগুলো  রবার্ট হুক দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। এগুলো ছিলো বিভিন্ন এককোষী অণুজীব। এভাবে বিজ্ঞানীরা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোষ দেখতে পান। মূলত এই যন্ত্র কোনো একটি ক্ষুদ্র নমুনাকে বিবর্ধিত করে আমাদের দেখায়। তাহলে কোনো নমুনাকে বিবর্ধন করতে সক্ষম যে যন্ত্রের মাধ্যমে কোনো ক্ষুদ্র বস্তুকে বড় আকারে পর্যবেক্ষণ করা যায় তাকে অণুবীক্ষণযন্ত্র বলে। 

জটিল আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্র

বর্তমানে আমরা গবেষণাগারে সাধারণত যে অণুবীক্ষণযন্ত্র দেখতে পাই, সেটা বিজ্ঞানী মহলে জটিল আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্র (Compound Light Microscope) নামে পরিচিত। একে সংক্ষেপে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্র (LM) বলা হয়। নিচের চিত্রে (১.৩) একটি জটিল আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের গঠন ও কাজ দেখানো হলো:

চিত্র ১.৩: জটিল আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্র

কার্য পদ্ধতি: প্রথমে নোজপিস ঘুরিয়ে 4x কিংবা 10x অবজেকটিভটি স্টেজের কেন্দ্র বরাবর লম্বভাবে স্থাপন করতে হবে। এবার কোর্স অ্যাডজাস্টমেন্ট নব ঘুরিয়ে স্টেজটিকে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠাতে হবে যার পরে নবটি আর ঘোরানো যায় না। এরপর স্টেজে স্লাইডটি স্থাপন করতে হবে। এখানে সদ্যপ্রস্তুত রক্তের স্মিয়ার স্টেইন করা স্লাইড কিংবা আগে থেকে প্রস্তুতকৃত স্থায়ী মাউন্টেড স্লাইড উভয়ই এক এক করে ব্যবহার করতে হবে। ডানে-বামে এবং সামনে-পেছনে স্লাইডটি সরিয়ে এমন অবস্থানে আনতে হবে যাতে স্টেজের মধ্যভাগের বৃত্তাকার ছিদ্র বরাবর স্লাইডের সেই অংশ থাকে যেখানে দ্রষ্টব্য বস্তুটি অবস্থিত। কনডেন্সার এবং অ্যাপার্চার প্রয়োজন মাফিক সমন্বয় করতে হবে। যত বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন অবজেকটিভ দিয়ে দেখা হবে, কনডেন্সার এবং আইরিস-ডায়াফ্রামের অ্যাপার্চার দিয়ে তত বেশি আলো ঢুকতে দিতে হবে।  

এবার আইপিসে চোখ রেখে সাবধানে কোর্স অ্যাডজাস্টমেন্ট নব ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে স্টেজ নামাতে হবে। যখনই বস্তু দৃশ্যমান হবে তখনই ফাইন অ্যাডজাস্টমেন্ট নব ঘুরিয়ে সেটিকে সঠিকভাবে ফোকাস করতে হবে। ফোকাস করা হয়ে গেলে স্টেজের নব ঘুরিয়ে স্লাইডটি ডানে-বামে এবং সামনে-পেছনে করে সেটির বিভিন্ন অংশ পর্যবেক্ষণ করতে হবে। 

সাধারণত প্রথমে কম বিবর্ধনে ফোকাস ও পর্যবেক্ষণ করে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর বিবর্ধনে ফোকাস ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। একবার 4x অবজেকটিভে বস্তুটি ফোকাস করা হয়ে গেলে স্লাইড স্থির রেখে নোজপিস ঘুরিয়ে 4x অবজেকটিভের জায়গায় 10x অবজেকটিভ এনে ফাইন অ্যাডজাস্টমেন্ট নব সামান্য ঘোরালেই সাধারণত 10x অবজেকটিভে ফোকাস সম্পন্ন হয়। তখন আর নতুন করে গোড়া থেকে ফোকাস করার দরকার হয় না। একই কথা প্রযোজ্য হবে 10x অবজেকটিভে ফোকাস করা স্লাইডকে 40x বা 45x অবজেকটিভে ফোকাস করার ক্ষেত্রে। এবার আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্র কিভাবে নমুনা বস্তুকে বিবর্ধণ করে, তা দেখি।  

চিত্র ১.৪: আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের মূলনীতি

প্রথমে আলোক উৎস থেকে নির্গত আলোক রশ্মি নমুনা বস্তুর উপর আপতিত হয়। এরপর আলোক রশ্মি নমুনা বস্তু মধ্য দিয়ে প্রবাহীত হয়ে অণুবীক্ষণযন্ত্রে সংযুক্ত অবজেকটিভ লেন্সে আপতিত হয়। লেন্সে আপতিত আলোক রশ্মিকে এমনভাবে প্রতিসরিত করে যেন নমুনা বস্তুটির ছবি বহুগুণে বর্ধিত হয়। অর্থাৎ যে বস্তুকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, তার ছবি লেন্সের মাধ্যমে বিশাল আকারে রূপান্তরিত হয়। এরপর বিবর্ধিত ছবি খালি চোখে বা ক্যামেরার মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট তিনটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো:

১.     বিবর্ধন (Magnification): কোনো বস্তুর বিম্বের দৈর্ঘ্য ও এর প্রকৃত দৈর্ঘ্যের অণুপাত হলো তার বিবর্ধন। এর মাধ্যমে কোনো একটি বস্তুকে তার স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় কতগুণ বড় দেখা যায়, তা প্রকাশ করা হয়। আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র কোনো বস্তুকে তার স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় সাধারণত ১০০০ গুণ বড় আকারে দেখাতে পারে। তবে এর চেয়েও বেশিগুণে বিবর্ধন সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে প্রতিবিম্বে বস্তুর বিভিন্ন অংশ স্পষ্টভাবে দেখা যাবে না।

২.     রেজোল্যুশন (Resolution): কোনো একটি বস্তু বা ছবির স্পষ্টতা নির্দেশ করে। দুটি ভিন্ন বিন্দুর মধ্যে নূন্যতম দূরত্ব কত হলে তাদেরকে আলাদা আলাদা বিন্দু হিসেবে দেখে বোঝা যাবে, সেটিই ঐ বস্তুর রেজোল্যুশন। যেমন: খালি চোখে আকাশের দিকে তাকালে যেটাকে একটি তারা বলে মনে হবে, টেলিস্কোপের সাহায্যে তার দিকে তাকালে পাশাপাশি দুটি তারা দেখা যেতে পারে, যা কিনা খালি চোখে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না। এক্ষেত্রে টেলিস্কোপটির রেজোল্যুশন চোখের চেয়ে বেশি। সাধারণ আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের রেজোল্যুশন ০.২ μস পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর অর্থ হলো ০.২ μস দূরত্বে দুটি ভিন্ন বিন্দু বা বস্তু থাকলে তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে দুটি ভিন্ন বিন্দু হিসাবে দেখে বোঝা যাবে।

৩.     কন্ট্রাস্ট (Contrast): কন্ট্রাস্ট কোনো একটি দৃশ্যের বিভিন্ন অংশের উজ্জলতার মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করে। এটার মাধ্যমে কোনো একটি নমুনার বিভিন্ন অঙ্গাণু আলাদা আলাদাভাবে স্পষ্ট হয়। কোনো একটা নমুনার স্পষ্টতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করে পর্যবেক্ষিত নমুনার কন্ট্রাস্ট বৃদ্ধি করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো নমুনা অণুবীক্ষণযন্ত্রে পর্যবেক্ষণের আগে বিশেষ ধরণের রঞ্জক পদার্থে নিমজ্জিত করে সেটা এর নিচে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

জীবকোষের ভেতরের অঙ্গাণুগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য জটিল আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের চেয়ে অধিক শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্র তৈরির চেষ্টার ধারাবহিকতায় আর বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৫০ সালের দিকে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে সংযোজিত হলো এক নতুন আবিষ্কার, সেটা হলো ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (Electron Microscope)। আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে কোনো বস্তু দেখার জন্য প্রতিফলিত আলোর সাহায্য নেওয়া হত, কিন্তু এই অণুবীক্ষণযন্ত্রে ব্যবহার করা হলো একঝাঁক ইলেকট্রন। 

আমরা জানি, রেজ্যুলেশনের সাথে তেজস্ক্রিয়তার একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হলে রেজ্যুলেশন কম হয়, অপরদিকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলে রেজ্যুলেশন বেশি হয়। এটি স্পষ্ট যে, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য অপেক্ষা ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম। ফলে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে কোনো বস্তুর যে রেজ্যুলেশন পাওয়া যায়, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি রেজ্যুলেশন পাওয়া যাবে। 

ফলে আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কোনো বস্তুর পুরো অংশ দৃশ্যমান না হলেও, ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে তার অধিকাংশ দৃশ্যমান হবে। এই ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এটি ০.০০২ হস আকারের বস্তুকে স্পষ্ট দৃশ্যমান করে। তবে বাস্তবিক পক্ষে এর ক্ষমতা ২x পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তবুও কোষ পর্যবেক্ষণ বা জীব নিয়ে গবেষণায় আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের পরিবর্তে এটি নিশ্চিতভাবে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণযন্ত্রের প্রধান শক্তি নিক্ষিপ্ত ইলেকট্রন। কোনো বস্তুর আপতিত ইলেকট্রন তিনটি ধর্ম প্রদর্শন করে:

১.     বস্তুর উপর নিক্ষিপ্ত ইলেকট্রনের কিছু অংশ এদিক সেদিক বেঁকে যায় বা বিচ্যুত হয়ে যায়। এদেরকে বিচ্যুত ইলেকট্রন বলা হয়।

২.     কিছু ইলেকট্রন বস্তুর পৃষ্ঠে আপতিত হওয়ার পর বস্তু উত্তপ্ত হয়। ফলে বস্তুর অভ্যন্তরের ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয়। এদেরকে বলা হয় সেকেন্ডারি ইলেকট্রন Secondary electron)।

৩.     কিছু সংখ্যক ইলেকট্রন বস্তু কর্তৃক শোষিত হয়।

প্রতিনিয়ত আমরা যেসব ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করি, তা প্রধানত দুই প্রকার। যেমন: স্ক্যানিং ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (Scanning Electron Microscope), যাকে সংক্ষেপে SEM বলা হয় এবং ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (Transmission Electron Microscope), যাকে সংক্ষেপে TEM বলা হয়।

স্ক্যানিং ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (SEM)

কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতল সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য স্ক্যানিং অণুবীক্ষণযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে অণুবীক্ষণযন্ত্রের ইলেকট্রন গান (ইলেকট্রনের উৎস) থেকে বস্তুর উপর ইলেকট্রন আপতিত হয়। ফলে আপতিত ইলেকট্রনের কিছু অংশ বিচ্যুত হয়, কিছু অংশ সেকেন্ডারি ইলেকট্রন উৎপন্ন করে এবং কিছু ইলেকট্রন বস্তু কর্তৃক শোষিত হয়। অণুবীক্ষণযন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন ডিটেক্টর বস্তুতে আপতনের পর ইলেক্ট্রনের এই তিন প্রকৃতি শনাক্ত করে। পাশাপাশি ইলেকট্রন নিগর্মনের সময় প্রকৃতি অনুযায়ী ইলেকট্রন প্যাটার্নকে ইলেকট্রনিক সংকেতে রূপান্তর করে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আইপিসে চোখ রাখলে ইলেকট্রন সংকেতের প্রেক্ষিতে ঐ বস্তুর বর্ধিত ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। 

এই অণুবীক্ষণযন্ত্রে ইলেকট্রনের কণা ধর্ম প্রয়োগ করে বস্তুর পৃষ্ঠদেশের ধরণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলেও বস্তুর বর্ণ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। এটি অনেকটা চোখ বেঁধে কোনো বস্তুকে স্পর্শ করার মত। তোমার চোখ বেঁধে যদি হাতে পাথর বা ইটের টুকরা দেওয়া হয়, তুমি কি এর রঙ বলতে পারবে? হাত দিয়ে স্পর্শ করে তুমি শুধু বলবে, এটির পৃষ্ঠ খসখসে বা মসৃণ, এটি গোলাকার বা সমতল, আকারে ছোট না বড়। একইভাবে, এই অণুবীক্ষণযন্ত্র শুধুমাত্র বস্তুর পৃষ্ঠদেশের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়।

ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (TEM)

কোনো বস্তুর ভেতরের গঠন স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র (TEM) ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রের কার্যপদ্ধতি অনেকটা স্ক্যানিং ইলেকট্রনিক অণুবীক্ষণযন্ত্রের মত। 
তবে পার্থক্য হলো SEM-এ ইলেকট্রন বস্তুকে ভেদ করে যেতে পারে না বরং বস্তুতে আপতিত হয়ে বিক্ষিপ্ত হয়। 
অপরদিকে ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে ইলেকট্রন বস্তুকে ভেদ করে চলে যায়। যে বস্তুকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে চাই, তার নমুনা প্রস্তুত করা এই অণুবীক্ষণযন্ত্রের সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে বস্তুর খুব পাতলা নমুনা ব্যবহার করা হয়। যেহেতু ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব কম, ফলে সে পাতলা (আল্ট্রাথিমিক) নমুনা ভেদ করে যেতে পারে। ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে রাখা নমুনা ভেদ করে যাওয়ার পর একটি প্রজেকশনে আপতিত হয়। ফলে প্রজেকশনে আপতিত ইলেক্ট্রন বস্তুর অভ্যন্তরের একটি প্রতিচ্ছবি গঠন করে। ফলে আমরা নমুনাটির অভ্যন্তরের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। 
অনেক সময় প্রদত্ত নমুনাকে ভারী ধাতু দিয়ে স্টেইন করা হয়। স্টেইন হলো অণুবীক্ষণযন্ত্রে কোনো নমুনার প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে দেখার জন্য বিশেষ পদার্থ (সেটা রঙিন হতে পারে) ব্যবহার করা। স্টেইন করার জন্য বিভিন্ন প্রকৃতির পদার্থ ব্যবহার করা হয়। ভারী ধাতু দিয়ে স্টেইনিং করলে ইলেকট্রন নমুনা বস্তুর কিছু কিছু অংশে বেশি পরিমাণে আপতিত হয়। ফলে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে নমুনা বস্তুটি অধিক স্পষ্টভাবে দেখা যায়। সাধারণত ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রের রেজ্যুলেশন ক্ষমতা ০.২ nm.  অন্যদিকে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের রেজ্যুলেশন ক্ষমতা ২০০ nm. ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে অনেক অঙ্গাণু পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। এই অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে কোনো বস্তুর পরমাণুর গঠন, অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়।  

এককথায় ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাপেক্ষে অনেক বেশি শক্তিশালী। যদিও কোষের অভ্যন্তরীণ অনেক অঙ্গাণু আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে সাহায্যে কখনো দৃশ্যমান হয় না। তবে এর মানে এই নয় যে জীব গবেষণায় আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের অবদান নগণ্য। এখ অবধি বিভিন্ন  গবেষণাগারে অহরহ এর ব্যবহার দেখা যায়। 

জীবিত কোষ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের ব্যবহার করা ভালো। কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে দেখার জন্য কোনো বস্তুর নমুনা প্রস্তুত করতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তাতে কোষ জীবিত থাকে না। গত কয়েক শতকে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের ব্যবহারের নতুন নতুন কৌশল ও পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। বর্তমানে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে আলো ব্যবহারের মাধ্যমে জীবের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গাণু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন বস্তুর সূক্ষ ত্রিমাত্রিক চিত্র পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। গত দশ বছরে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারের মাধ্যমে আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের রেজ্যুলেশন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আলোক অণুবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে ১০-১২ nm রেজ্যুলেশনে বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। 

সব মিলিয়ে জীব গবেষণার অগ্রসরতার সাথে সাথে অণুবীক্ষণযন্ত্রের অগ্রগতি হয়েছে। কারণ কোষের গঠন পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো অণুবীক্ষণযন্ত্র। তবে এটা সত্য যে, কোষের রহস্য উদঘাটনে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পাশাপাশি জৈবরসায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ জরুরি। কারণ জীবের অভ্যন্তরিন রাসায়নিক গঠন, বিভিন্ন বিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে জৈব রসায়নের ধারণা প্রয়োজন।  কোনো জীবের রাসায়নিক ক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সাইটোলজি (কোষের গঠন সম্পর্কিত বিজ্ঞান) ও জৈবরসায়নের সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকতে হবে। (চলবে…)

কোষ গবেষণায় বিভিন্ন ব্যবহৃত বিভিন্ন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে এতক্ষণ পড়াশোনা করে কী জানলে? নিজেকে যাচাই করতে নিজের দক্ষতা লেভেল জানার জন্য যুক্ত থাকে। আগামীকাল গুগল ফরমে পরীক্ষা নেওয়া হবে।

 

সূত্র: Campbell Biology (মূল ক্যাম্পবেল বায়োলজির কোষ ইউনিট নিয়ে বাংলায় “ক্যাম্পবেল বায়োলজি (কোষ ইউনিট) প্রকাশ করেছে ল্যাববাংলা প্রকাশনী)

 


 


 

 

 

 

Blogger দ্বারা পরিচালিত.