আউশ ধানের উচ্চফলনশীল জাত পরিচিতি
ধান বাংলাদেশের প্রধান ফসল। আমাদের প্রধান খাবার ভাত হওয়ার কারণে দেশের বিপুল পরিমাণ জমিতে ধানের আবাদ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সাধারণত তিন মৌসুমে ধানের আবাদ করা হয়। ধান আবাদের ভিত্তিতে আউশ, আমন ও বোরো তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রতি বিঘায় পূর্বের তুলনায় অধিক পরিমাণ ফলন পাওয়া যায়। ধান গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউট হিরন্ময় নাম। পাশাপাশি বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করা হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্ভাবিত ধানের পাশাপাশি কৃষক স্থানীয় জাতের ধান আবাদ করে থাকে। অধিকাংশ ধান আমন ও বোরো মৌসুমে আবাদ হলেও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের ফলে বর্তমানে আউশ ধানের আবাদ ব্যপক জনপ্রিয় হয়েছে। আউশ মৌসুমে আবাদযোগ্য এমন কয়েকটি জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল ধানের জাত সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।
বোনা আউশ (বীজ ছিটায়ে বপন করা হয়)
১) ব্রি ধান ৪৩: ব্রি ধান ৪৩ বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত বোনা আউশ ধানের একটি জাত। জাতটি ২০০৪ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ব্রি ধান ৪৩ প্রধানত দেশের খরাপ্রবণ এলাকায় (যেমন, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, চুয়াডাঙ্গা) বপনযোগ্য।
জাতের বৈশিষ্ট্য
ক) আগাম জাত। প্রচলিত অন্যান্য ধান কর্তন উপযোগী হওয়ার পূর্বে এই ধান সংগ্রহ করা যায়।
খ) জাতটি প্রচন্ড খরা, তাপদাহ বা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।
গ) এই ধানগাছের উচ্চতা ১০০ সেন্টিমিটার।
ঘ) কান্ড বেশ শক্ত বলে সহজে হেলে পড়ে
না।
ঙ) চাল মাঝারি মোটা
জীবনকাল: ব্রি ধান ৪৩ এর জীবনকাল ১০০ দিন। এককথায় বীজতলায় চারা দেওয়া থেকে ফসল সংগ্রহ করতে ১০০ দিন সময় প্রয়োজন হয়।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৪৩ হেক্টর প্রতি ৩.৫ টন (শতকে ১৪.১৭ কিলোগ্রাম) ফলন দেয়।
২) ব্রি ধান ৬৫: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত আউশ মৌসুমের একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি বোনো আউশ ধান হিসেবে ব্রি ধান ৪২ ও ব্রি ধান ৪৩ জাতের চাষাবাদ উপযোগী এলাকায় সরাসরি মাঠে বপনের জাত হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে
জাতের বৈশিষ্ট্য
ক) ব্রি ধান ৬৫ বোনো আউশ মৌসুমের খরা সহনশীল জাত।
খ) উচ্চ ফলনশীল।
গ) ধান গাছের উচ্চতা ৯০-৯৫ সে.মি.
ঘ) চাল মাঝারি চিকন, সাদা ও ভাত ঝরঝরে।
জীবনকাল: ব্রি ধান ৬৫ জাতের জীবনকাল ব্রি ধান ৪৩ এর চেয়ে কম এবং গাছ তুলনামূলকভাবে খাটো ও শক্ত হওয়ায় হেলে পড়ে না। ব্রি ধান ৬৫ ধান গাছের শীষ থেকে সহজে ধান ঝরে পড়ে না। এ জাতের ডিগ পাতা খাড়া। জীবনকাল ৮৮-১০০ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৬৫ হেক্টর প্রতি ৩.৫-৪ টন ফলন দেয়।৩) ব্রি ধান ৮৩: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত বোনা আউশ ধানের একটি জাত। জাতটি ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ব্রি ধান ৪৩ প্রধানত দেশের খরাপ্রবণ এলাকায় (যেমন, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, চুয়াডাঙ্গা) বপনযোগ্য।
জাতের বৈশিষ্ট্য
ক) আধুনিক উফশি (উচ্চ ফলনশীল জাত) জাতের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
খ) গাছের উচ্চতা ১০০-১০৫ সেন্টিমিটার
গ) এই জাতের ধান খরা সহনশীল এবং ধান পাকার পরও গাছ ঢলে পড়ে না।
ঘ) চাল মাঝারি মোটা, সাদা এবং ভাত ঝরঝরা।
ঙ) চালে অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৬% ।
চ) দানার রং লালচে যা স্থানীয় কটকতারা জাতের অনুরূপ।
জীবনকাল: জাতটির জীবনকাল ১০৫ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৬৫ হেক্টর প্রতি ৪-৫.৩ টন ফলন দেয়।রোপা আউশ (বীজতলায় চারা উৎপাদন করে মূল জমিতে চারা রোপণ করা হয়
১) ব্রি ধান ৪৮: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত রোপা আউশ মৌসুমের একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি ২০০৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় রোপা আউশ ধান হিসেবে আবাদ করা যায়।
জাতের বৈশিষ্ট্য
ক) আগাম জাত। প্রচলিত অন্যান্য ধান কর্তন উপযোগী হওয়ার পূর্বে এই ধান সংগ্রহ করা যায়।
খ) গাছের উচ্চতা ১০৫ সেন্টিমিটার
গ) এই জাতের ধান গাছের কান্ড শক্ত। ফলে সহজে হেলে পড়ে না।
ঘ) চাল মাঝারি মোটা ও সাদা
ঙ) চালে প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৫%
জীবনকাল: ব্রি ধান ৪৮ জাতের জীবনকাল ১১০ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৪৮ হেক্টর প্রতি ৫ টন (শতকে ২০.২৪ কিলোগ্রাম) ফলন দেয়।
২) ব্রি ধান ৮২: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত রোপা আউশ মৌসুমের একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে।
জাতের বৈশিষ্ট্য
ক) আধুনিক উফশি (উচ্চ ফলনশীল জাত) জাতের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
খ) গাছের উচ্চতা ১১০ সেন্টিমিটার
গ) এই জাতের ধান গাছের ডিগপাতা সামান্য হেলানো। ধানের শিষগুলো উপরে থাকে।
ঘ) স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুছির সংখ্যা ১০-১২ টি।
ঙ) দানায় অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৭% এবং প্রোটিনের পরিমাণ ৭.৬%।
চ) ১০০০ টি ধানের ওজন ২৩.৮ গ্রাম।
জীবনকাল: ব্রি ধান ৮২ জাতের জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৮২ হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫.৫ টন দেয়।
৩) ব্রি ধান ৮৫: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত রোপা আউশ মৌসুমের একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি ২০১৭ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে।
জাতটির বৈশিষ্ট্য:
ক) আধুনিক উফশি (উচ্চ ফলনশীল জাত) জাতের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
খ) এই জাতের ডিগ পাতা খাড়া, কিছু সরু ও লম্বা। পাতার রং সবুজ।
গ) এই জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর শিষগুলো গাছের উপরের দিকে থাকে।
ঘ) পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা প্রায় ১১০ সে.মি.
ঙ) ধানের রং সোনালি ও আকৃতি চিকন এবং মাঝারি লম্বা।
চ) চাল মাঝারি লম্বা ও চিকন এবং ভাত ঝরঝরে।
ছ) ১০০০ টি পুষ্ট চালের ওজন প্রায় ২২.৩ গ্রাম।
জ) দানায় অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৬%।
জীবনকাল: ব্রি ধান ৮৫ জাতের জীবনকাল ১০৮-১১০ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৮৫ হেক্টর প্রতি ৪.৫-৫ টন এমনকি ৫.৫ টন ফলন দিতে সক্ষম।
৪) ব্রি ধান ৯৮: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত রোপা আউশ মৌসুমের একটি উচ্চফলনশীল জাত। জাতটি ২০২০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে।
জাতটির বৈশিষ্ট্য:
ক) আধুনিক উফশি (উচ্চ ফলনশীল জাত) জাতের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
খ) এই জাতের ডিগ পাতা খাড়া এবং পাতার রং গাঢ় সবুজ।
গ) পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা প্রায় ১০৩-১০৬ সে.মি.
ঙ) চাল লম্বা, চিকন ও সাদা।
চ) ধানের দানার রঙ সোনালি।
ছ) ১০০০ টি পুষ্ট চালের ওজন প্রায় ২২.৬ গ্রাম।
জ) চালে অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৭.৯% এবং প্রোটিন ৯.৫%
জীবনকাল: ব্রি ধান ৯৮ জাতের জীবনকাল ১১২ দিন।
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি ধান ৯৮ হেক্টর প্রতি ৫.০৯ টন এমনকি ৫.৮৭ টন ফলন দিতে সক্ষম।
৫) ব্রি হাইব্রিড ধান ৭: বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত রোপা আউশ মৌসুমের একমাত্র হাইব্রিড জাত। জাতটি আউশ মৌসুমে চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলে চাষাবাদের জন্য ২০২০ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড এই জাতটির অনুমোদন দেয়।
জাতটির বৈশিষ্ট্য:
ক) পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১০১-১০৫ সে.মি.
খ) স্বাভাবিক অবস্থায় গাছ প্রতি গুছির সংখ্যা ১২-১৫ টি
গ) কান্ড শক্ত বিধায় ঢলে পড়ার সম্ভাবনা কম
ঘ) ১০০০ টি পুষ্ট দানার ওজন ২১.৫ গ্রাম।
ঙ) চালে অ্যামাইলেজের পরিমাণ ২৩% এবং প্রোটিন ১০.৩ %
জীবনকাল: ১০৫-১১০ দিন
ফলন: সঠিক নিয়মে চাষাবাদ করলে ব্রি হাইব্রিড ধান ৭ হেক্টর প্রতি ৬.৫-৭ টন ফলন দিতে সক্ষম।
৬) বিনা ধান ১৯: বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত আউশ ও আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী জাত।
জাতটির বৈশিষ্ট্য
ক)
জাতটি খরা সহিষ্ণু। প্রচন্ড খরার সময় গাছের বাড়বাড়তি বন্ধ থাকে। আবার যখন অনুকূল
পরিবেশ আসে তখন দ্রুত বাড়তি সম্পন্ন করে স্বাভাবিক ফলন দিতে সক্ষম
খ) নেরিকা-১০ জাত থেকে উদ্ভাবিত
গ) আউশ ও আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী
ঘ) বরেন্দ্র ও পাহাড়ী এলাকাসহ সারাদেশে বৃষ্টি নির্ভর অবস্থায় সরাসরি রোপন (ডিবলিং) উপযোগী
ঙ) চাল সরু ও লম্বা
ঙ) সেচের পানি সাশ্রয়ী
জীবনকাল: ৯৫-১০৫দিন
ফলন: আউশ মৌসুমে গড় ফলন ৩.৮৪ টন/হে. ও সর্বোচ্চ ফলন ৫.০ টন/হে.
আমন মৌসুমে গড় ফলন ৫.১৬ টন/হে. ও সর্বোচ্চ ফলন ৫.৫টন/হে.
৭) বিনা ধান ২১: বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত আউশ মৌসুমে চাষ উপযোগী জাত।
জাতটির বৈশিষ্ট্য
ক) পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৯৪-৯৬ সে.মি । গাছ খাটো ও খাড়া বিধায় হেলে পড়ে না।
খ) ১০০০ ধানের ওজন ২১.৩ গ্রাম । চাল সাদা রঙের, লম্বা ও চিকন। চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ শতকরা ২৪.৯ ভাগ
গ) রান্নার পরে ভাত ঝড়ঝড়া হয় ও খেতে সুস্বাদু।
ঘ) লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের খরা পীড়িত বরেন্দ্র অঞ্চলসহ প্রায় সকল উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমিতে এ জাতটির ভাল ফলন দেয়।
জীবনকাল: ১০০-১০৫ দিন
ফলন: খরা প্রবন এলাকায় গড় ফলন ৪.৫ টন/হেক্টর ।
তথ্য সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট