-->

পেঁয়াজের বাম্পার ফলন পেতে যা করণীয়

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফসলের মধ্যে পিঁয়াজ একটি। মসলা ফসল হিসেবে পরিচিত পিঁয়াজ কম বেশি সব অঞ্চলেই আবাদ হয়। এটি প্রধানত শীতকালীন ফসল। তবে ইদানিং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজ আবাদ শুরু হয়েছে। প্রথমে বীজ থেকে বীজতলায় চারা উৎপাদনের পর প্রধান জমিতে পিঁয়াজের চারা রোপণ করা হয়। প্রধান জমিতে আবাদকৃত পেঁয়াজের বাল্ব আমরা মসলা হিসেবে গ্রহণ করি। পেঁয়াজের বাল্বের মানের উপর ভিত্তি করে পিঁয়াজের ফলন কম বেশি হয়। পাশাপাশি দাম নির্ধারিত হয়। তাই পিঁয়াজের উচ্চ ফলনের জন্য কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। পেঁয়াজের অধিক ফলনের জন্য চারা উৎপাদন ও মূল জমিতে চারা রোপণের পর নিয়মিত যত্ন নেওয়া জরুরী। পেঁয়াজের বাম্পার ফলন পাওয়ার জন্য বীজতলা ও মূল জমিতে যে বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা নিয়ে এবারের আয়োজন।

বীজতলার যত্ন

পেঁয়াজের চারা রোগমুক্ত ও সুস্থ হলে তা থেকে উৎপাদিত বাল্বের মান ভালো হবে। তাই পেঁয়াজের বীজ বপনের সময় থেকে প্রতিনিয়ত নিম্নোক্ত বিষয় মেনে চলতে হবে।


১) বীজতলা শোধন: বীজতলায় বীজ বপনের পূর্বে বীজতলার মাটি শোধন করতে হবে। বীজতলার মাটি শোধন করলে মাটিতে থাকা রোগ জীবাণু মারা যাবে। ফলে চারায় রোগ পোকামাকড়ের আক্রমণ কমে যাবে। বীজতলার মাটি শোধনের উপায় হলো,

  • বীজ বপনের আগে বীজতলায় ৫-৬ সে.মি. পুরু করে কাঠের গুড়া/ধানের তুষ ছড়িয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে।
  •  বীজতলায় বীজ বপনের আগে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ গ্রাম হারে এ্যাসেন্ড/রাগবি/রিজেন্ট প্রয়োগ করতে হবে।

২) বীজ শোধন: ফসলের রোগের বড় মাধ্যম বীজ। বীজের সাথে জীবাণু থাকলে তা থেকে পরবর্তীতে চারায় রোগের আক্রমণ হয়। বীজ বপনের পূর্বে শোধন করে নিলে বীজ বাহিত রোগ রোধ করা সম্ভব। পিঁয়াজের বীজ বপনের পূর্বে নিম্নোক্তভাবে শোধন করে নিতে হবে।

  • এক লিটার পানিতে ৩-৪ গ্রাম সিকিউর/রোভরাল/ব্যাভিস্টিন মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরী করতে হবে। এরপর এক কেজি বীজ ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে বীজ নিঙ্গর দিয়ে বীজতলায় বপন করতে হবে।
৩) বীজের হার: ‍সুস্থ ও সুন্দর চারা উৎপাদনের জন্য সঠিক হারে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। সঠিক নিয়মে বীজ বপন করলে একদিকে চারা সুন্দর হয় এবং অন্যদিকে বীজের পরিমাণ কম লাগে। সাধারণত প্রতি শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণের জন্য বীজতলায় ১৬ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে। এককথায় ১৬ গ্রাম বীজের চারা দিয়ে ১ শতাংশ জমি রোপন করা যায়। তবে মূল জমিতে সরাসরি বপন পদ্ধতিতে পেঁয়াজ আবাদের জন্য শতক প্রতি ২৬ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে। তবে ভালো মানের চারা উৎপাদনের জন্য আদর্শ বীজতলা তৈরী করতে হবে। আদর্শ বীজতলায় পেঁয়াজের চারা উৎপাদনের নিয়ম:-
  • প্রতি শতাংশে ২৫০ গ্রাম বীজ বপন করতে হবে।
  •  বীজতলার প্রতি শতাংশে ৮ কেজি ঝুরঝুরা গোবর সার/কম্পোস্ট/মুরগীর বিষ্টা প্রয়োগ করা উচিত।
  • ২৫শে অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করা উচিত।

চারা রোপণ ও বাল্ব উৎপাদন কৌশল:

পেঁয়াজের উচ্চ ফলনের জন্য মূল জমি তৈরীর পাশাপাশি চারা রোপণ ও যত্ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বীজতলা চারা উৎপাদনের পর তা মূল জমিতে রোপণ করা হয়। মূল জমিতে চারা বেড়ে উঠে এবং বাল্ব হয়। তাই মূল জমিতে চারা রোপণ থেকে শুরু করে বাল্ব সংগ্রহ নাগাদ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপর বাল্বের ফলন নির্ভর করে।

১) মূল জমিতে সারের মাত্রা

দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে পেঁয়াজ ভালো হয়। জমিতে সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে পিঁয়াজের ফলন ভালো হয়। নিম্নে প্রদত্ত হারে পেয়াঁজের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে।

সারের নাম

পরিমাণ

প্রয়োগ সময়

শেষ চাষের সময়

রোপনের ২৫ দিন পর

রোপনের ৫০ দিন পর

গোবর

২০ কেজি/শতাংশ

২০ কেজি/শতাংশ

-

-

ইউরিয়া

১০৫০ গ্রাম/শতাংশ

৩৫০ গ্রাম/শতাংশ

৩৫০ গ্রাম/শতাংশ

৩৫০ গ্রাম/শতাংশ

টিএসপি

১১০০ গ্রাম/শতাংশ

১১০০ গ্রাম/শতাংশ

 

 

এমওপি

৬০০ গ্রাম/শতাংশ

৩০০ গ্রাম/শতাংশ

১৫০ গ্রাম/শতাংশ

১৫০ গ্রাম/শতাংশ

জিপসাম

৪৫০ গ্রাম/শতাংশ

৪৫০ গ্রাম/শতাংশ

 

 

 

২) চারা শোধন ও রোপণ: চারায় থাকা রোগ জীবাণু থেকে রোগ হওয়া রক্ষায় চারা মূল জমিতে রোপণের পূর্বে নিম্নোক্তভাবে চারা শোধন করে নিতে হবে। পাশাপাশি সঠিক নিয়মে চারা রোপণ করতে হবে।

  • বীজতলা থেকে চারা উত্তোলনের পর ১% ব্যাভিস্টিন (১ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম) দ্রবনে চারার শিকড় ৫ মিনিট ভিজিয়ে/চুবিয়ে শোধন করতে হবে।
  • ৫০-৫৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে।
  • চারায় রোগ/পোকার আক্রমণ হলে দ্রুত ছত্রাকনাশক/কীটনাশক স্প্রে করতে হবে

৩) রোগ বালাই দমন ব্যবস্থাপনা: পেঁয়াজের লিফ ব্লচ, ব্ল্যাক স্টক রোগ, বাল্ব পচা, পার্পল ব্লচ, চারার গোড়া পঁচা রোগসহ কয়েকটি রোগ হয়ে থাকে। পেঁয়াজে রোগের আক্রমণ দেখা দিলে ফলন কমে যায়। অনেকসময় জমিতে কোনো বাল্ব উৎপন্ন হয় না। পেঁয়াজের জমিতে চারা রোপণের পর থেকে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে রোগ দমন করা যায়।

  • চারা রোপনের ৩০ দিন পর প্রথম স্প্রে: ক্যাবরিওটপ/এন্ট্রাকল (১ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম) স্প্রে করতে হবে। ৫ শতাংশ জমির জন্য ১০ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ ১০ লিটার পানিতে ৩০ গ্রাম মিশিয়ে ০৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
  • প্রথম স্প্রের ১২ দিন পর (অর্থাৎ চারা রোপণের ৪২ দিন পর): মীম ৫২.৫০ ডব্লিউপি/রোভরাল (২গ্রাম/লিটার)+মোবেন্টু (২মিলি/লিটার)+রিডোমিল গোল্ড (২.৫ গ্রাম/লিটার) স্প্রে করতে হবে।
  • দ্বিতীয় স্প্রের ১২ দিন পর (অর্থাৎ চারা রোপনের ৫৪ দিন পর): নাটিভো (১০ লিটার পানিতে ৮ গ্রাম)/এমিস্টার টপ (২মি.লি./লিটার)/সিকিউর (২গ্রাম/লিটার) স্প্রে করতে হবে।

বি.দ্র: এরপরেও আবাহাওয়াগত কারণে কোনো রোগের প্রাদর্ভাব দেখা দিলে নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে রোগ দমন করুন।

৪) পেঁয়াজের থ্রিপস ও মাকড় দমন: পেঁয়াজের জমিতে যে সকল রোগের আক্রমণ দেখা দেয় তার মধ্যে থ্রিপস ও মাকড় অন্যতম। নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে এসব পোকামাকড় দমন করা যায়।

  • থ্রিপস দমন: আক্রমণ দেখা  দিলে প্রথম বার ইন্ট্রিপীড ১.৫ মি.লি./লিটার হারে স্প্রে করতে হবে। প্রথম বার স্প্রে করার ৭ দিন পর এডমায়ার ১ মি.লি./লিটার স্প্রে করতে হবে। দ্বিতীয়বার স্প্রে করার ৭ দিন পর ভলিয়াম ফ্লেক্সি ১ মি.লি./লিটার অথবা ট্রেসার ১মি.লি./লিটার অথবা প্রিন্স/এসেন্ড ১ মি.লি./লিটার হারে স্প্রে করতে হবে।
  •  মাকড় দমন: ভার্টিমেক ২মি.লি./লিটার ও ডাইমেথয়েট গ্রুপের কীটনাশক ২মি.লি./লিটার অলটারনেট পদ্ধতিতে স্প্রে করতে হবে।

এছাড়াও যে কোনো পোকামাকড়ের উপস্থিতি দেখা দিলে নিকটস্থ উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে পোকামাকড় দমন করতে হবে।

সঠিক নিয়মে পিঁয়াজ আবাদের পর পরিপক্ক হলে বাল্ব সংগ্রহ করতে হবে। পিঁয়াজ জমি থেকে উত্তোলনের পর সঠিক নিয়মে বাল্ব কেটে সংরক্ষণ করতে হবে।

সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি প্রযুক্তি হাত বই,  আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও প্লান্ট ডিজেস ক্লিনিক

 



Blogger দ্বারা পরিচালিত.