জলবায়ু পরিবর্তন রোধের সাত উপায়
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। বিভিন্ন জল্পনা কল্পনা শেষে বিশ্ব নেতারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন অনুধাবন করেছেন। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের ঐক্যমত ও বাস্তবায়নের জোড় তাগিদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক হবে।
তবে শুধু আলোচনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া আর ফটোসেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে প্রকৃত অর্থে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কতটা ফলপ্রসূ কাজ হবে তা প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধে প্রকৃত অর্থে দেশগুলোর কিছু কাজ করতে হবে, যার মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি হ্রাস পাবে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্ব রক্ষা পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বহুবিধ কাজের প্রধানত সাতটি কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব নেতারা আলোচন্য সাতটি কাজ বাস্তবায়নের ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি লাগাম টেনে ধরা যাবে এবং আগামী বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন রফিকুল ইসলাম
জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস:
জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে তা থেকে অধিক মাত্রায় কার্বন-ডা্ গ্যাস নির্গত হয়। প্রতিনিয়ত আমরা জীবাশ্ম জ্বালানী হিসেবে তেল, গ্যাস বিশেষ করে কয়লা ব্যবহার করি। বায়ুমন্ডলে নিঃসরিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ আটকে রেখে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ই্স্যু। তাপমাত্র বৃদ্ধি রোধে অবশ্যই দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানী উৎপাদনে প্রথম সারির দেশগুলো ( অস্ট্রোলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত) এই জ্বালানী ব্যবহার হ্রাসের বিপক্ষে এবং কপ ২৬ সম্মেলনে তারা এই সম্মতিতে স্বাক্ষর করে নি।
মিথেন গ্যাস নিগর্মন হ্রাস করা :
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মিথেন গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা গেলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। মিথেন গ্যাস তাপমাত্র বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে। তেল নিষ্কাশনের সময় প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো হয় যা থেকে ব্যাপক মাত্রায় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। অবশ্যই প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর বিকল্প হিসেবে ভিন্ন পরিবেশ বান্ধব উপায় বের করতে হবে। এর মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি বর্জ্য পদার্থ বিনষ্টকরণের জন্য পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ স্তুপীকৃত বর্জ্য পদার্থ থেকে প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।
নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি:
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে জ্বালানী খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বৈশ্বিক অর্থনীতির যে কোনো খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ ও তাপশক্তি উৎপাদন খাত জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এলক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের নেতাদের একযোগে কাজ করতে হবে। সভ্যতার উন্নতির ধারায় প্রতিয়িনত বিদ্যুৎ ও তাপের ব্যবহার বাড়বে কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে একদিকে বিদ্যুৎ বা তাপের চাহিদা পূরণ হবে, অন্যদিকে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এর ফলে আমাদের বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী নির্ভরতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভরতা থেকে ক্লিন এনার্জি তথা ডিকার্বোনাইজেশন প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঝুঁকতে হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক লক্ষ্য ও চাহিদা বিবেচনায় এমন পদক্ষেপ কঠিন হবে।
অন্যদিকে বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের ফলে জ্বালানী চাহিদা মিটতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব নেতাদের প্রস্তাবিত নিট জিরো বাস্তবায়নে নবায়নযোগ্য ততা বায়ু ও সৌরশক্তির ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। তবে এই পথ এতটা সহজ নয়। কারণ বাতাসের গতিবেগ কম হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হবে। এক্ষেত্রে আমাদের উন্নত ব্যটারি উদ্ভাবনের পথে হাঁটতে হবে যেন প্রয়োজনীয় শক্তি তথা বিদ্যুৎ সঞ্চয় এবং প্রয়োজন মাফিক তার ব্যবহার করা যায়।
পেট্রোল ও ডিজেলের ব্যবহার:
সভ্যতার উন্নরি সাথে সাথে সমৃদ্ধ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতিনিয়ত সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে নতুন নতুন বাহনের ব্যবহার বাড়ছে। আর জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পেট্রোল, ডিজেল, অকটনেরে মতো জ্বালানী। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অবশ্যই যানবাহনে ডিজেল ও পেট্রোলের ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। এসকল জ্বালানী ব্যবহার কমিয়ে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে পারে একটি সমাধান। তবে ইলেক্ট্রিক যানবাহনের ব্যবহার বৃদ্ধি যথেষ্ট জটিল কাজ। এক্ষেত্রে হাইড্রোজেন জ্বালানী হতে পারে যানবাহনের উৎকৃষ্ট জ্বালানী। নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত হাইড্রোজেন জ্বালানী আগামীতে পরিবেশ বান্ধব পরিবহন খাতের স্বপ্ন দেখাতে পারে। পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা বিমানের জন্য নতুন, বিশুদ্ধ জ¦ালানী উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও পরিবেশবাদীরা মনে করেন আকাশপথে দূষণ কমাতে দেশগুলোর বিমানের সংখ্যা কমাতে হবে।
বৃক্ষরোপণের হার বৃদ্ধি:
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধে বৃক্ষরোপনের চেয়ে উৎকৃষ্ট পদ্ধতি আর হতে পারে না। প্রয়োজনের তাগিদে গাছ কাটা হলেও দেশগুলোকে বৃক্ষ রোপণের হার বাড়াতে হবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ জানায়, “বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হলে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস দূর করতে হবে”। বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূর করতে গাছের বিকল্প নেই। গাছ সারোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন করতে বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে। পরিবেশবাদী এবং বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে বৃক্ষনিধন বন্ধ করার দাবির পিছনে এটি একটি বড় যুক্তি।
বায়ু থেকে গ্রীন হাউস গ্যাস দূরীকরণ:
গ্রীন হাউস গ্যাস সূর্য থেকে আগত তাপ পৃথিবী পৃষ্টে প্রতিফলিত হওয়ার পর মহাশূণ্যে বিলীন হওয়ার পথে বাঁধা। এর ফলে পৃথিবী উষ্ম থাকে। তবে গ্রীন হাউস গ্যাসের মাত্রা অধিক হলে পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়। ফলে পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন ধারণ ব্যহত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বায়ুমন্ডল থেকে গ্রীন হাউস গ্যাস দূর করতে হবে। বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রীন হাউস গ্যাস কৃত্রিমভাবে দূর করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অথবা গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পর এর উৎস থেকে অন্য স্থানে সম্প্রসারণ রোধ করা গেলে পরিবেশে এসকল গ্যাসের প্রভাব অনেকাংশে রোধ করা যায়। ইতিমথ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বায়ুমন্ডল থেকে গ্রীন হাউস গ্যাস দূর করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে টেক্সাসের ‘কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং’ এবং সুইজারল্যান্ডের ‘ক্লাইমওয়ার্কস’ অন্যতম। তারা একটি রাসায়নিক পদার্থের ফিল্টারের ভিতর দিয়ে বিশাল ফ্যানের সাহায্যে বায়ুমন্ডলে বাতাস নির্গত করে বায়ুমন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। অন্য একটি পদ্ধতি হলো, কার্বন বন্দী ও সংরক্ষণ (capture and storage) । এই পদ্ধতিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎস যেমন কয়লার জ¦ালানী প্লান্ট থেকে বিশেষ যন্ত্র গ্যাস শোষণ করে এবং শোষণকৃত গ্যাস ভূগর্ভের অভ্যন্তরে পতিত করা হয়। তবে এসকল প্রযুক্তি বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ।
দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান:
২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়। যদিও নির্ধারিত সময়সীমা পার হয়নি, তবে এবারের সম্মেলনের সভাপতি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এই সহায়তা ২০২৩ সালের মধ্যে প্রদানের পরিকল্পনা প্রদান করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, দরিদ্র দেশগুলোকে গ্রীন এনার্জির দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়লা নির্ভরতা কমাতে ৮.৫ বিলিয়ান ডলার প্রদান করেছে।