-->

গোলক ধাঁধাঁর ফাঁদে, ভোলা দা এবার কাঁদে !

 

সময়টা ২০৫৫ সালের ২৫ ফ্রেবুয়ারি। ভোলা দা একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। এতবছর পর ভোলা দার মনে হলো কিছু একটা শেখা দরকার। এতদিন তো শুধু ঘুরে ঘুরে সময় কাটলো। রাত জেগে নৌকায় শুয়ে পানির স্রোতের শব্দ শুনে, নির্জন বনে গাছের পাতার শব্দের ভাষা বুঝতে চেয়ে বা পূর্নিমা রাতে গাছের মগডালে বসে পুরো পৃথিবীর রং খুঁজতে চেয়ে কি আসলেই কোনো লাভ হয়েছে! শুধু শুধু আপনজনের বিরক্তির কারণ, বন্ধুদের হারানো আর সমাজের চোখে একজন ভবঘুরে, আকাইম্মা হিসেবে পরিচিতি বেড়েছে। তবে বন্ধু হিসেবে জুটেছে সাপ, ব্যাঙ, অজানা গাছ, রাতের পেঁচা, শিয়াল এবং গহীন বনের বানর।

যাইহোক বহু বছর পর পরিবারের জোড়াজুড়ি ভোলাদা এখন নিজ গৃহে। নিজ গৃহ বলাটা ঠিক নয়। এটি আসলে ভোলাদার বাবার বাড়ি। বাবা মা আকাশের নক্ষত্রের দলে ভিড় করায় এই বাড়িটি নিকট আত্মীয়দের হয়ে গেছে। কোনো এক অজানা কারণে ভোলা দা হঠাত লোকালয়ে এসেছে। চারপাশে সব উচ্চ শিক্ষিত মানুষের ভিড় দেখে ভোলাদা যেন গতভম্ব। রাস্তার চারপাশে বিশাল বিশাল পর্দায় অচেনা ভাষায় গান চলছে, মোড়ের ডিজিটাল চায়ের দোকানে বিশাল পর্দায় অচেনা ভাষা ও তালে গান বাজছে। দোকানে বসা প্রত্যেকের হাতে বিশাল আকৃতির ডিজিটাল বই। এটি দেখলে ভোলা দার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। এমন আকৃতির কাঠের পাটাতনের উপর মা কাপড় পরিষ্কার করতেন। ভোলাদা ভাবে এত বড় জিনিস কিভাবে হাতে নিয়ে বেড়ায় এই মানুষগুলো। চারদিকে এমন জ্ঞানের ছড়াছড়ি দেখে ভোলা দা নিজেকে বোকা মনে করে। এত বছরে ভোলাদার মগজে তো গোবর ছাড়া কিছু নেই।
পাশের বাড়ির মদন এখন আমেরিকায়। এমন অনেক চেনা মানুষ, বন্ধু আজ দেশের বড় বড় কর্তা, বিদেশের বড় বড় কোম্পানির মালিক। তাদের কত ক্ষমতা, কত সম্মান। আর জঙ্গল ফেরৎ ভোলাদাকে রাস্তার কেউ দেখলে আড়চোখে তাকায়, শুধু কয়েকটি চতুষ্পদ জন্তু পাশ দিয়ে ঘুরে। সবার চোখে ভোলাদা একজন নাদান বা এক হাজার বছর পিছিয়ে থাকা কোনো সমাজের প্রাণি যে হঠাৎ করে এদের মাঝে আবির্ভুত হয়েছে। এসব দেখে অপমানে, লজ্জায় ভোলা দা সিদ্ধান্ত নিল যে সে শিক্ষিত হবে। কিছু না হোক কয়েকটি ডিগ্রি নিয়ে নামের পাশে লিখবে। এমনকি মৃত্যুর পর খোদাই করে নিজের নামে নিচে লিখে রাখতে বলবে।
এই বয়সে শিক্ষা লাভের জন্য কিছু মানুষের সাথে ভোলাদার আলাপ হয়েছে। কয়েকজেনর সাথে কথা বলে জেনেছে যে, কি শিখলাম এটা বিষয় না, দরকার কয়েকটি ডিগ্রি তা যেকোনোভাবে পেলেই হবে। এই সুযোগ তো হাতছাড়া করা যাবে না। কি শিখলাম, কি জানলাম বা কাজে লাগবে কি না সেটা না, শুধু পাশ করে একটি কাগজ নিতে পারলেই নামের নিচে লিখে দিতে পারলেই হলো।
আপাতত ভোলা দা খুঁজছে একটি প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে ডিগ্রি নেওয়া যায়। আর একটি খোঁদাই করার দোকান। কারণ ভর্তি হতে পারলেই খোঁদাইয়ের কাজের অর্ডার দিয়ে দিবে। একটি ডিগ্রির নামসহ বাড়ির দরজায় টাঙানোর জন্য, অন্যটি কবরের পাশে টাঙানোর জন্য। অবশ্য তার মৃত্যুর পর সত্যিই কবরের পাশে টানানো যাবে কি না তা নিয়ে সে সন্দিহান। পরিচিত কয়েকজনের চেষ্টায় একটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলো। মনে মনে তৃপ্ত হলো ভোলা দা। এবার আর চিন্তা নাই। সে নতুন করে শুরু করবে। অনেক জ্ঞান অর্জন করবে, ডিগ্রি পাবে। কেউ তাকে মূর্খ বলতে পারবে না।
গাছ কাটা রোধে একবার এক বড় বাবুর সাথে তার তর্ক হয়েছিল। শেষ বেলায় বড় বাবু বলেছিল গাছ থাকলে পরিবেশ ভালো থাকবে এটা বলার আপনি কে। আপনার মত মূর্খের কাছে এটা শিখতে হবে? জানেন, আমি এই চেয়ারে এমনি বসি নি। আমার কত ক্ষমতা আপনি জানেন? আমার কত ডিগ্রি আছে, দেশ বিদেশে প্রশিক্ষণ আছে?
এবার সেই বড় বাবুকে উচিত জবাব দেওয়া যাবে বলে ভাবছে ভোলা দা। অবশ্য গাছ নিয়ে ভোলাদা বিভিন্ন বিষয় জেনেছে বই পড়ে, বিভিন্ন গবেষণা, জার্নাল থেকে। শুধু ডিগ্রি আর চেয়ার নেই বলে তার কথা পঁচা ডিমের মত ছুড়ে ফেলে দিছে। এবার ডিগ্রি পেলে প্রয়োজনে সনদ গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে যাবে সেই বড় বাবুর কাছে।
যাই হোক এত ভেবে লাভ নেই। শুধু ডিগ্রির অভাবে এমন অনেকে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বেড় করে দিছে। তাই সে বার বার ফিরে গেছে নদীর বুকে, জঙ্গলে । খুঁজে খুঁজে গাছের মগডালে বসে নিচের বিশাল পৃথিবীকে দেখেছে। আর এমন সব মহাজ্ঞানী, ডিগ্রিধারী, ক্ষমতাবান বাবুদের কথা ভেবেছে।
অতপর ভর্তি হলো ভোলাদা । এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এটি। ভোর, সকাল, দুপুর, বিকাল, রাত্র এমন বিভিন্ন সময়ে এখানে কোর্স করা যায়। যার যে বিষয় ভালো লাগে এমন সকল বিষয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। একটি বিশাল লাইব্রেরী আছে, তবে সেখানে যে কেউ প্রবেশ করতে পারে না। ভোলা দা জানতে পেরেছ এখানে শুধু জ্ঞানীরা প্রবেশের সুযোগ পায়। ভোলাদার মত নাদান, বলদদের এখানে কোনো স্থান নেই। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানে সবাই পড়তে আসে, কেউ জ্ঞানী না কারণ তারা শিক্ষার্থী, তাই কর্তৃপক্ষ কাউকে লাইব্রেরীতে ঢুকতে দেয় না। শুধুমাত্র বিশাল কাঁচের দেয়ালের বাইরে থেকে থাকে থাকে সাজানো বই দেখা যায়। আর কিছু কর্মী পরিষ্কার কাপড় দিয়ে যত্ন সহকারে বই পরিষ্কার করে এমন দৃশ্য চোখে মেলে। ভোলা দার লাইব্রেরীতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তাই বাইরে থেকে সিনেমার পোস্টার দেখার মত কল্পনায় বই পড়ার সাধ মিটায়।
শুরু হলো প্রথম দিনের ক্লাস।ক্লাসে প্রবেশ করলেন এজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সেরাদের একজন। সকল শিক্ষার্থী নীরবে বসে আছে। সামনে কয়েকটি চেয়ার থাকা সত্ত্বেও ভোলা দা পিছনের চেয়ারে বসা। তার মতে, ক্লাসে সবসময় পিছনে বসা বুদ্ধিমানের কাজ। এতে ক্লাসে মনযোগ দেয়ার পাশাপাশি নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করা যায়। আবার পিছনে বসলে স্যারের সকল কথা শুনতে পাওয়া যায়, তার মগজ থেকে নিসৃত জ্ঞান আলোর মত পিছনে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা টর্চ লাইটের মত। আর সামনে বসলে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যাথা হয়, অন্যদিকে স্যারের কথা সুন্দর হয়ে কানে পৌছায় না। এটা আসলে ভোলা দার নিজস্ব অভিমত।
যাইহোক, ভোলা দা দেখলেন ভদ্রলোক ক্লাসে ঢুকেই ল্যাপটপের সুইচ অন করলেন। সামনে বিশাল পর্দায় ভেসে উঠল ল্যাপটপের মনিটর। মনিটরের ওয়ালপেপার বলে দিচ্ছে ব্যক্তি সত্যি মেধাবী ও দেশ বরেণ্য পন্ডিত। সবার মনযোগ আকর্ষণ করে পন্ডিত ব্যক্তিটি বললেন,
- আমার ক্লাসের শর্ত তিনটি। এক-ক্লাসে কোনো শব্দ করা যাবে না, দুই- আমি লেকচার দিতে থাকবো আর তোমরা হুবুহু লিখতে থাকবে, কে কতটা লিখছ তা উপর মার্কিং হবে, তিন-লেকচার চলাকালীন সময়ে কেউ সামনের দিকে তাকাতে পারবে না।
খুশি মনে ভোলা দা তার নতুন কেনা খাতা বের করলেন। শুরু হলো লেকচার। বেশ গতিতে সুন্দর উচ্চারণে বলে যাচ্ছেন সেই পন্ডিত ব্যক্তি। ভোলা দা তার বলার সাথে পাল্লা দিয়ে পেড়ে উঠছে না। তবুও লিখতে হবে তাই লিখে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে খাতার দিকে তাকিয়ে লিখছে। কোনোভাবে তার কথা বাদ দেওয়া যাবে না। হঠাৎ কোথথেকে এক মশা না মাছি এসে বসল ভোলা দার চোখের পাতার উপরে। হয়তো পথ চিনতে ভুল করেছে, বা জঙ্গলে থাকতে ভোলা দার সাথে বেশ ভাব জমানো কোনো এক পতঙ্গ সে। ওকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে ভোলা দার মাথা উঁচু করতে হলো। ভোলা দা দেখলেন সকল শিক্ষার্থী মাথা নিচু করে লিখছে। পন্ডিত ব্যক্তি বলে চলেছেন তার বক্তব্য। তবে তিনি তাকিয়ে আছেন সামনের পর্দার দিকে, যেখানে লেখা স্লাইডের প্রতিটি বাক্য তার মুখের বক্তব্যের সাথে হুবুুহু মিলে যাচ্ছে। ভোলা দা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। দেখলেন তাদের ক্লাস নেওয়া সেই পন্ডিত ব্যক্তি একের পর এক স্লাইডের শুরু থেকে শেষ অবধি পড়ে চলেছেন, মাঝে মাঝে গতি কমছে, বাড়ছে কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যত দ্রুত পারেন তার পড়া শেষ করতে।
অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন ভোলা দা। তাকিয়ে আছেন জানালার দিকে। বাইরে দন্ডায়মান এক বিশাল গাছ। মন চাইছে গাছের মাথায় বসে ক্লাসের লেকচার শুনি। উপায় নেই কারণ এত উঁচু থেকে এই ক্লাসের লেকচার শোনার সুযোগ নেই। একটু দুরে বিশাল বটগাছের প্রকান্ড শরীর যেন হয়ে উঠেছে এক বিশাল ব্লাকবোর্ড। সেখানে চক হাতে ঢিলঢিলে জামা প্যান্ট পড়া একজন ঝাঁকড়া চুলের মানব। যিনি বোর্ডের এক কোনায় লিখে রেখেছেন ’আজকের আলোচ্য বিষয়”। একটি টপিকস বলছেন আর কথা বলছেন সে বিষয়ে। কি সে প্রাঙ্জল শব্দ, উচ্চারণ, আর সাথে উদাহরণ। প্রতিটি বিষয়ের সাথে বলছেন এর গবেষণা, ইতিহাস, ছবি আঁকছেন চক দিয়ে, প্রতিটি অংশ বুঝাচ্ছেন। শেষ বেলায় যেন ভেসে উঠল বিশাল পর্দা, সামনের ছোট টেবিলে ল্যাপটপ। সেই ব্যক্তি ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন। বললেন এতক্ষন যে টপিকস নিয়ে কথা হলো তার কিছু ছবি ও ভিডিও দেখো। এবার আরোও বেশি মনযোগী হয়ে ভোলা দা দেখছে। এতক্ষণ আলোচনার সাথে মিলে যাওয়া সুন্দর সুন্দর ছবি, আর শেষে পুরো আলোচনা সহজে বুঝাতে একটি ভিডিও। তারপর..........................................................
Blogger দ্বারা পরিচালিত.