শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে অনাগ্রহ ও আমাদের করণীয়
আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের কোন বিকল্প নেই। উন্নত এবং সমগ্র বিশ্বে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী সকল দেশ বিজ্ঞানের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। একমাত্র বিজ্ঞানই পারে নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে আধুনিক জাতি গঠন করতে। ঠিক যে সময়ে পৃথিবীর সমগ্র দেশ বিজ্ঞানের উন্নয়নে তৎপর, সে সময়ে বাংলাদেশের চিত্র বেদনাদায়ক। গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল ২০১৪) দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত “বিজ্ঞানে অনাগ্রহ কমছে শিক্ষার্থী” প্রতিবেদনে এটি স্পষ্ট যে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগে পড়–য়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সরকারী ও বেসরকারী গবেষণায় এটি স্পষ্ট যে বিজ্ঞানে আমাদের গতি নি¤œমুখী। “বিজ্ঞানের কোন বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি ও তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?” এমন বিষয়কে সামনে রেখে আমি ও ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী (সমন্বয়ক, বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটি) গত বছর থেকে গবেষণা করছি। আগামী কয়েকবছর আমরা বাংলাদেশের সকল অন্চলের শিক্ষার্থীদের মাঝে অনুসন্ধান চালাব। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে কেন? বিজ্ঞান বিষয় পঠনে কোন উপাদানগুলো আবশ্যক তা জানতে পারলে আমরা কারণ অনুসন্ধান করতে পারবো। বিজ্ঞান একটি পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান। ব্যবহারিক ও তত্ত্বীয় দুটি অংশই বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে জড়িত।
প্রথমত, বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। শিক্ষককে বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট বিষয়ে তত্বীয় জ্ঞান থাকলে হবে না, তাকে হতে হবে হাতে কলমে দক্ষ । বিষয়টির সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য জ্ঞান যা শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলবে ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পরিচালনার সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। শহরের প্রতিষ্ঠানে এই সমস্যাটি প্রকট না হলেও গ্রামের চিত্র করুণ। তবে আমাদের পিছন ইতিহাস যথেষ্ট উন্নত যখন গ্রামের প্রতিষ্টানে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক শিক্ষা প্রদান করতেন। আমার বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এমন একজন শিক্ষককে দেখে যাকে আমি আমার জীবনের প্রথম বিজ্ঞানী বলে থাকি। শ্রদ্ধেয় আমানুল্লাহ স্যার যার কাছ থেকে প্রথম আমি অনুবীক্ষণ যন্ত্রে পিঁয়াজের কোষ দেখেছিলাম। আমি যে প্রতিষ্ঠানে (পান্টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুমারখালি, কুষ্টিয়া) পড়তাম সেই প্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগ নেয়ার পূর্বেই সকল শিক্ষার্থাদের কঙ্কালতন্ত্র, প্রিজমে আলোর প্রতিসরণ ইত্যাদি দেখার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে এমন চিত্র একসময় খুবই স্বাভাবিক ছিল। বর্তমানে প্রতিষ্টানগুলোতে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের মূল স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে উন্নত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা আবশ্যক। বাংলাদেশের মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাগারের সংখ্যা অতি নগণ্য। অনেক প্রতিষ্টানে গবেষণাগার থাকলেও যথাযথ ব্যবহার নেই। গবেষণাগার হিসেবে একটি কক্ষ ও কয়েকটি যন্ত্রপাতি যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি অধিক আগ্রহ গড়ে তুলতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান সমৃদ্ধ গবেষণাগারের কোন বিকল্প নেই। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে গবেষণা করার সুযোগ দিতে হবে। এমন অসংখ্য প্রতিষ্টান আছে যেখানে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় আগ্রহ দেখায় না। এর অনেকগুলো কারণের একটি জরিমানা ভীতি। শিক্ষার্থীদের প্রথমেই জানানো হয় কোন যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তাকে জরিমানা প্রদান করতে হবে। এর ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী কোন পরীক্ষণ থেকে বিরত থাকে।
তৃতীয়ত, আধুনিক তথ্য ও গবেষণা সমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তকের বহুল ব্যবহার যা শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন জ্ঞান আহরণে সহযোগীতা করবে। পাঠ্যপুস্তকের পাশপাশি অসংখ্য বিজ্ঞান বই থাকবে যা তাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করবে। দেশে বিদেশের বিজ্ঞানী ও গবেষণা সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকা খুবই প্রয়োজন। লক্ষ্য করা যায় যে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের সকল বিজ্ঞানী ও তাদের কাজ সম্পর্কে খুব কমই জানে। শিক্ষার্থীরা অধিক গবেষণা সম্পর্কে জানলে তাদের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হবে যা তাদের নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান পিপাসা বৃদ্ধি করবে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে হবে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তক সৃজনশীল পদ্ধতির অনুকরণে, তবুও তথ্য ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ করা আবশ্যক। মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানের বইয়ের চিত্রগুলো রঙিন হওয়া খুবই জরুরী। একজন শিক্ষার্থী পড়ছে গাছের পাতা সবুজ কিন্তু দেখছে সাদা-কালো যা তাদের চিন্তার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে।
চতুর্থ, শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ভাবনার প্রসারণের স্বার্থে বিজ্ঞান কর্মসূচি ও ভ্রমণওে আয়োজন করতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিজ্ঞান উৎসব, বিজ্ঞান পাঠের আসরের আয়োজন করলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের মূল বিষয় অনুধাবন করতে পারবে। নিজেদের প্রতিভা উপস্থাপনের লক্ষ্যে নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করবে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞান স্থাপনা ভ্রমণ শিক্ষার্থীদের চিন্তার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে। তবে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। তবে এক্ষেত্রেও শহরের কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রতীয়মান হলেও গ্রামে খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না।
আলোচনায় এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান যে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারের প্রধান উপাদানগুলোর অপূর্ণতায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহের প্রধান কারণ। এছাড়াও পড়াশোনা শেষে কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সুষ্টি না হওয়ার অন্যতম কারণ। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে বাণিজ্য শাখা চালুর পর থেকে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষাথী কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিষয়টি সবচেয়ে অগ্রসরমান ক্ষেত্র। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দ্রুত প্রসার বাণিজ্য বিষয়ের শিক্ষার্থীদের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। অপরদিকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের কর্মস্থল গবেষণা প্রতিষ্টানগুলোর অবস্থা নাজুক। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। দেখা যায় বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে অনেক শিক্ষার্থী এম.বি.এ করছেন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হচ্ছেন। সেই তুলনায় বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে না । ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
সূত্রানুযায়ী ২০০৯ সালে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল ১৪,৫১,০০০ জন, এর মধ্যে ২০১০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে ২,৪০,০০০জন, ২০১১ সালে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী ২,১৬,০০০জন এবং ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ১,৩৮০০০ জন। এই সংখ্যা থেকে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের অবস্থান সহজে অনুধাবন করা যায়। তবে শিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহী এমনটা ভাবার কোন সুযোগ নেই। একজন বিজ্ঞাকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গমন ও ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। প্রতিক্ষেত্রে আমি বিজ্ঞানের প্রতি তাদের তীব্র আগ্রহ লক্ষ্য করেছি । কিন্তু তাদের এই আগ্রহ শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অনেক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বি.সি.এস.আই.আর ,বিজ্ঞান একাডেমী বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিযোগীতার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতি, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটি, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটি, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড কমিটি, ডিসকাশন প্রজেক্ট, বাংলাদেশ এস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, অনুসন্ধিৎসু চক্র প্রভৃতি সংগঠন বিজ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের মাঝে অধিক জনপ্রিয় করে তুলেছে। বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ থাকলে তা দূর করার জন্য যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারী-বেসরকারী বিজ্ঞান সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিজ্ঞানীদেও সমন্বয়ে একটি জাতীয় বিজ্ঞান কমিশন গঠন করতে হবে।কমিশনের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনুসন্ধান ও পরিকল্পনা গ্রহণ। এর আওতায় থাকতে পারে- বিজ্ঞানের শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, গবেষণাগারের আধুনিকায়ন, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, গবেষকদের সার্বিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, গবেষণা প্রতিষ্টানে অধিক গুরুত্ব প্রদান ইত্যাদি। এই সকল ক্ষেত্রের সঠিক বাস্তবায়নই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত এক জাতি। যা বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের স্বপ্ন “২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যে কেউ বিজ্ঞানে নোবেল নিয়ে আসবে” বাস্তবায়ন করবে।