-->

নিউক্লিও শক্তির জননী লিস মিটনার


পরমাণুর নাটকীয় ভাঙনের পর নিউক্লিয় ফিশনের আবিষ্কার যা পৃথিবীতে শক্তিক্ষেত্রে অভাবনীয় পরিবর্তন সৃষ্টি করেছিল। সারা বিশের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার একটি নিউক্লিয়ার ফিশন। কিন্তু এই ফিশন প্রক্রিয়ার পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তার সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে। ইনি একজন নারী পদার্থবিদ যিনি নাৎসি জার্মানি থেকে নাটকীয়ভাবে পলায়নের পরপরই নিউক্লিয় শক্তির এই বিক্রিয়া আবিষ্কার করেন। এত বিখ্যাত আবিষ্কারের পরও লিস মিটনারকে তার প্রকৃত সম্মান দেওয়া হয়নি। এই অবিষ্কারের জন্য তার ত্রিশ বছরের ল্যাবরেটরি সঙ্গী অটো হ্যানকে রসায়নে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়। ধারণা করা হয় নাৎসি জার্মানী থেকে সুইডেনে পলায়ন ও তার গবেষণা সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করবে এই কারণ দেখিয়ে তাকে নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়। আলবার্ট আইনস্টাইন নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের এই ভিয়েনা-দেশীয় সম্মানীয় অগ্রদূতকে  ‘আমাদের মাদাম কুরি’ বলে সম্মানিত করেছেন।
লিসের পিতামাতা ছিল ভিয়েনাদেশিও ইহুদি। তার বাবা ফিলিপ ছিলেন আইনবিদ। ১৮৭৩ সালে তিনি হেডুইগ স্কভিয়াঙ্কে বিয়ে করেন। লিসের জন্ম ৭ নভেম্বর ১৮৭৮। আট ভাইবোনের মধ্যে মিটনার ছিলেন তৃতীয়। 
ছোটবেলায় লিসের গণিতের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে বাবা-মা একজন প্রাইভেট টিউটর রেখে দেন। তার বাবা মনে করতেন ছেলেদের মত মেয়েদেরও সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। ঐ সময় অস্ট্রিয়ায় মেয়েরা সাধারনত ছেলেদের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পেত না। তবে লিস মিটনার ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা’ তে কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাসের মাধ্যমে একজন মেয়ে হিসেবে নিজের  মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
লিস মিটনার দ্বিতীয় নারী হিসাবে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি করেন এবং এখানেই তিনি কোয়ান্টাম তত্তের জনক ম্যাক্স প্লাঙ্কের সাথে পরিচিত হন। ১৯০৭ সালে প্লাঙ্ক মিটনারকে বার্লিনে আসার আমন্ত্রণ জানান। আর এটিই ছিল তার ক্যারিয়ারের জন্য একটি মাইলফলক। ১৯০৭ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত তিনি বিনা বেতনে ‘বার্লিন ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রি’ তে গবেষণারত বৈজ্ঞানিক হিসাবে কাজ করেন। ১৯০৭ সালে তিনি তেজস্ক্রিয় রসায়নবিদ অটো হানের সাথে পরিচিত হন যিনি পরবর্তীতে তার ত্রিশ বছরের পরীক্ষামূলক কাজের গবেষণা সহযোগী ছিলেন।
একই বছর ১৯০৭ সালে প্লাঙ্কের আমন্ত্রনে আইনস্টাইন বার্লিনে আসেন। আইনস্টাইন, মিটনার, পল এহরেনফেস্ট এবং আরও অনেকে প্রায় সন্ধ্যায় প্লাঙ্কের বাড়িতে গানের আসর বসাতেন এবং আড্ডা দিতেন। লিস প্লাঙ্কের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সহকারি হিসাবে আনুমানিক ৭ বছর কাজ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অটোহ্যান কাইজার ভিলহেল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালক হন। এই প্রতিষ্ঠানে মিটনার দোতালার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পরিদর্শক হিসাবে প্রায় ২০ বছর কাজ করেন। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৪,এই দশ বছরে এই গবেষকদলের গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পরে এবং নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিটনার তিনবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হন।
১৯২২ সালে মিটনার ইউনিভার্সিটির লেকচারার হন। তিনি তার কয়েকজন গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট নিয়ে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার অনেকগুলো কোর্স পরিচালনা করতেন। ১৯৩৩ সালে এক লেকচার ট্যুরে আমেরিকায় এসে আইনস্টাইন হিটলারের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। এসময় তার বইখাতা পুরিয়ে ফেলা হয় এবং তার আপেক্ষিকতত্ত্বের কাজগুলোকে নষ্ট করা হয়। মিটনার এসব নৃশংস কাজের রেকর্ড রাখেন এবং বিভিন্ন সহকর্মীর কাছে চিঠির মাধ্যমে প্রেরণ করেন।
১৯৩৮ সালের পর বিপদ বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ সংস্থা এবং ড্যানিস পদার্থবিদ নিলস বোর যে বার্লিন থেকে পালানোর পথ তৈরি করেন তা তিনি জানতেন না। এমনকি তার ঘনিষ্ট সহকর্মী অটো হ্যানেরও এই বিষয়টি অজানা ছিল।
স্টকহোমে তিনি যুদ্ধের বাকি দিনগুলোতে নতুন নোবেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্সে কাজ করতে থাকেন। অনেক সুইডিস বিজ্ঞানিই গোপনীয় ডিফেন্স ওয়ার্ক নিয়ে কাজ করার সময় তাকে অবহেলা করতে থাকেন। ছুটির সময়ে তিনি তার ভাইপো অটো রবার্ট ফিলচকে দেখতে যান। ২৪ ডিসেম্বর অদ্ভুত বার্স্টিং পুননিরিক্ষনের ব্যাপারে তিনি অটো হানের একটি চিঠি পান যেখানে ইউরেনিয়ামে ঘটার ফলে ব্যারিয়াম উৎপন্ন হয়। হ্যান তার বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মীর কাছে এই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন।  ‘এই ধরনের বার্স্টিং এর ব্যাপারে ফিজিক্স কি বলে? তা তিনি মিটনারের কাছে জানতে চাইলেন। মিটনারের প্রদত্ত উত্তর অটো হ্যান লিপিবিদ্ধ করেন এবং বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রকাশ করেন। তবে তার এই অবিষ্কারের পিছনে মিটনারের অবদান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। ফলে ১৯৩৮ সালে নিউক্লিয় ফিশন আবিষ্কারে লিস মিটনারের অবদানকে অন্ধকারে থেকে গেল।
একদিন মিটনার এবং তার ভাইপো সুইডিশ জঙ্গলে পদভ্রমণের পথে ‘বার্স্টিং’ নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।তারা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা শেষে কিছু তত্ত্ব উদ্ভাবন করলেন। মিটনার স্ক্র্যাপ পেপারের উপরেই ফর্মুলা লিখে ফেললেন এবং ভাইপে ফ্রিসচকে বারবার বলতে লাগলেন দ্রুত কোপেনহেগেন ল্যাবরেটরিতে ফিরে গিয়ে পরীক্ষাটা করে দেখতে। লিস সুইডেনে ফিরে আসলেন। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি-মাচ সময়ে  এ. আর. ফ্রিসচকে সাথে নিয়ে তিনি ‘ন্যাচার’ পত্রিকায় ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয় ফিশনের উপরে অনেকগুলো আর্টিকেল প্রকাশ করলেন।
যুদ্ধের বিপক্ষে এবং মেয়েদের বিজ্ঞানে না পড়ার কুসংস্কারের পিছনে লেগে থেকে মিটনারের গল্প সত্যিই অনেক দু:খের ছিল। লিস মিটনার এবং আইনস্টাইন সেইসব অল্প কিছু বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্র গবেষণায় কাজ করেন নি।
১৯৪৭সালে হ্যান এবং স্ট্রেসম্যান তাদের পুনর্গঠিত ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রি অব মিনজে, মিটনারকে আমন্ত্রণ করেন। তিনি অটো হ্যানকে লেখেন যারা যুদ্ধের সময় জার্মানিতে রয়ে গেছে তারা হয়ত তাকে জায়গা দেবে না। বরং তিনি তাদের গুরূর নামে ‘ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রি’ গঠন করার আহবান জানান এবং ইতিমধ্যে সুইডেনে প্রেসিডেন্ট, টেগ আরলেন্দার এর সাথে আপোষ করে খুব অল্প পেনসন নিয়ে অবসরে চলে যান।
লিস মিটনার আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সম্মাননা, উপাধি পেয়েছেন । মিটনার তার ভ্রমনের অধিকাংশ সময় মেয়েদের বিজ্ঞান পড়ায় উৎসাহিত করতে কাটিয়েছেন ।  ‘মনে রেখ বিজ্ঞানই পারে তোমার জীবনে আনন্দ এবং সন্তোষ নিয়ে আসতে’ এই কথাটি তিনি সবার মাঝে প্রচার করেছেন। শেষ বছরগুলোতে তিনি ভাইপো অটো রবার্ট ফ্রিসচ এর সাথে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে বাস করতেন। আর সেখানেই ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর এই মহিয়সী নারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।



Blogger দ্বারা পরিচালিত.