কালো বিষের ছোবলে সুন্দরবন
একটি দেশের অবস্থান,প্রাকৃতিক বৈচিত্র,সম্পদ,উৎপত্তি রহস্য,ভাষা.সম্পদ প্রভৃতি মিলিয়ে একটি চিত্র সৃষ্টি করে যা সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোন একটি দেশকে নিয়ে কল্পনা করলে সবার প্রথমে এমন কিছু চিত্র ভেসে উঠে যার দ্বারা দেশটি সর্বাধিক আলোচিত ও সম্মানিত। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাম শুনলেই চোখের সামনে স্ট্যচু অব লিবার্টি ভেসে উঠবে। একইভাবে ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, ভারতের তাজমহল,মিশরের পিরামিড এই সকল দেশকে আন্তজার্তিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বকারী সম্পদ হল সুন্দরবন। দশ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই বনের ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অন্তর্গত। পদ্মা,মেঘনা ও ব্রম্মপুত্র নদীর অববাহিকায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন নিজ বুকে ধারণ করে আছে। পুরো সুন্দরবনের ত্রিশ ভাগ জল দ্বারা বেষ্টিত। শত শত প্রজাতির বিভিন্ন আকারের উদ্ভিদ ও প্রাণী পুরো সুন্দরবনে একটি শৃঙ্খল গড়ে তুলেছে। সুন্দরী,গরান,গেওয়া এবং কেওড়া বনের প্রধান উদ্ভিদ হলেও মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায় সুন্দরবনে। এক গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনে ১২০ প্রজাতির মাছ,২৭০ প্রজাতির পাখি,৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর বাস করে। এর মধ্যে বাঘ,হরিণ,কুমিড়,কচ্ছপ,বিভিন্ন প্রজাতির সাপ অন্যতম। সার্বিক দিক দিয়ে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদের আবাসভূমি। এর নিদর্শন হিসেবে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে। আর্থিক দিক দিয়ে সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। সুন্দরবনের পাশ্ববর্তী এলাকার ১০ লক্ষ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ৭০ হাজার মানুষ সরাসরি মৎস শিকার করে। অন্যদিকে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা। ভৌগলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে রয়েছে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বাধিক। বিভিন্ন দেশে যে হারে পরিবেশ দূষণ চলছে তা অকল্পনীয়। উন্নত প্রযুক্তি,শিল্পকারখানা প্রসার প্রভৃতির মাধ্যমে সারা বিশ্বের জলবায়ুর স্বাভাবিক অবস্থাকে ব্যাহত করেছে। ফলাফল হিসেবে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও অধিক হারে বরফ গলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এর পিছনের কারণগুলো একদিনের নয়। বছরের পর বছর ধরে শুধুমাত্র মুনাফা লাভের আসায় পরিবেশ ধ্বংস করে শিল্পয়ান,নগরায়ণের বিস্তার ঘটাচ্ছি আমরা। যার প্রতিদান হিসেবে প্রকৃতি সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রতিদান দিচ্ছে। আমরা বিভিন্ন দেশের ভয়াবহ জলোচ্ছাস,টর্নেডো,অসহনীয় তাপমাত্রা,ঋতুবদল লক্ষ্য করেছে। ফলে টনক নড়েছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের। বহুবছর ধরে কয়েকটি দেশের গোড়ামি থাকলেও সাম্প্রতিক সম্মেলনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার একটি সিদ্ধান্তে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের সব দেশে নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সবাই তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুদিন পূর্বে বিজ্ঞানীরা আমাজান মহাবন সম্পর্কে একটি গুরূত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। হাজার হাজার বর্গমাইল এলাকা মানুষের দ্বারা ধ্বংস হওয়ার সারা বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রয়েছে। আসলে বনভূমির ভূমিকা এমনই ব্যাপক। যে অঞ্চল থেকেই বনভূমি হ্রাস পাক না কেন সারা বিশ্বে তার প্রভাব পড়বেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বছরের পর বছর ধরে আমাদের বনভূমি ধ্বংস,গণহারে উদ্ভিদ ও প্রাণী ধ্বংসের ফলাফল কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি। সিডর,আইলা, বৃষ্টিহীন বর্ষা,শীতকালে অসহনীয় শীত,ছয়টি ঋতুর দেখা না পাওয়া প্রভৃতিই হল আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের পুরস্কার। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় আমরা সচেতন না। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মত আমরা বহুবছর ধরে তিলে তিলে ধ্বংস করে চলেছি আমাদের সুন্দরবনকে। গণহারে কাঠ সংগ্রহ,কুমিড়,হরিণ, বাঘ হত্যা সহ বিভিন্ন প্রজাতি নিধন যেন আমাদের নিত্যদিনের ঘটনা। কাঠ ব্যবসার নামে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিধন আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় লক্ষ্য করেছি। দেখা গেছে ১৯৮০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৬৫ টি বাঘ পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অপরদিকে গত ৩১ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের কারণে ১৪৫ টি বাঘের মৃত্যু ঘটেছে। এছাড়াও বনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন পণ্যবাহী ট্যাংকার গমন, সমুদ্র নিকটবর্তী অন্চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা দ্বারা এই বনভূমিকে তিলে তিলে শেষ করার মহড়া করছিলাম আমরা। আর সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে গেল একটি ভয়াবহ ঘটনা। খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফর্নেস তেল গোপালগন্জের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র যাওয়ার পথে শেলা নদীর চাঁদপাই রেন্জে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। আর তেল ছড়িয়ে পরেছে সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায়। এর ফলে সমগ্র এলাকার প্রজাতিকূল তেলের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই অবস্থা পরিবর্তনে তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা নেওয় হয় নি। স্থানীয় মানুষজন গ্রাম্য পদ্ধতিতে তেল সংগ্রহের চেষ্টা করছে। কেউ বিদেশে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন বলে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপÍরা কোন পদক্ষেপ নিতে সাহস পাচ্ছেন না। আমরা পত্রিকার পাতায় পড়ছি,হা-হুতাশ করছি তা ছাড়া কিবা করার আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপরওয়ালার বলতে শোনা গেল কালো তেলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হয় নি। সত্যি কি তাই! অনেক দেরিতে হলেও তেল অপসারণের উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে। এখন দেশী বিদেশী সংস্থার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অনেক বড় ক্ষতি তো হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই কাঁকড়া,মাছ মরে উঠতে শুরু করেছে, কুমিড়ের দেখা নেই। এগুলো প্রাথমিক ঘটনা। তেলের পুরো আস্তরণ যেভাবে লেগে আছে তাতে বৃহৎ ক্ষতিসাধন হবে সুন্দরবনের। শ্বাসনালীর মাধ্যমে অক্সিজেন নেওয়া উদ্ভিদগুলোর ক্ষেত্রে মুত্যু ব্যাতীত অন্য রাস্তা নেই। মাটির সাথে লেগে থাকা ও পানিতে ভাসমান এই তেলের সুদূর প্রসারি প্রভাব হল-জলজ প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি, বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ প্রজাতির মৃত্যু, উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণকারী অন্যান্য প্রজাতির মৃত্যু বা খাদ্যের অভাবে অন্য স্থানে গমন। আর এই সবকিছুর সবচেয়ে বড় প্রভাব আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনে। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লবণাক্ততা বড় ধরণের হুমকির কারণ ছিল উদ্ভিদের জন্য। এখন নতুন একটি বিষ যুক্ত হল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হুমকিতে থাকা আমাদের এই দেশটির সবচেয়ে বড় রক্ষককে ধ্বংস করা হল। এর একটি সুদূরপ্রসারি প্রভাবের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে। প্রাকৃতিক বিপযয়ের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া। সুন্দরবনের এই ভয়ানক অবস্থা মোকাবেলাসহ সামনে এই বনকে রক্ষার সবরকম ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এভাবে পর্যায়ক্রমে ঘটতে থাকলে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় কোন ভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। প্রকৃতির প্রতি আঘাত হানলে তার প্রতিদান সে দেবেই, আর তা হবে সুদূরপ্রসারী,অকল্পনীয় ও অপূরণীয়।
রফিকুল ইসলাম, বিজ্ঞানকর্মী